৪৭.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – নরেন্দ্র ও হাজরা মহাশয়
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলরামের দ্বিতলের বৈঠকখানায় ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। সহাস্যবদন। ভক্তদের সঙ্গে কথা কহিতেছেন। নরেন্দ্র, মাস্টার, ভবনাথ, পূর্ণ, পল্টু, ছোট নরেন, গিরিশ, রামবাবু, দ্বিজ, বিনোদ ইত্যাদি অনেক ভক্ত চতুর্দিকে বসিয়া আছেন।
আজ শনিবার (২৭শে বৈশাখ, ১২৯২)—বেলা ৩টা—বৈশাখ কৃষ্ণাদশমী, ৯ই মে, ১৮৮৫।
বলরাম বাড়িতে নাই, শরীর অসুস্থ থাকাতে, মুঙ্গেরে জলবায়ু পরিবর্তন করিতে গিয়াছেন। জ্যেষ্ঠা কন্যা (এখন স্বর্গগতা) ঠাকুর ও ভক্তদের নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া মহোত্সব করিয়াছেন। ঠাকুর খাওয়া-দাওয়ার পর একটু বিশ্রাম করিতেছেন।
ঠাকুর মাস্টারকে বারবার জিজ্ঞাসা করিতেছেন, “তুমি বল, আমি কি উদার?” ভবনাথ সহাস্যে বলিতেছেন, “উনি আর কি বলবেন, চুপ করে থাকবেন!”
একজন হিন্দুস্থানী ভিখারী গান গাইতে আসিয়াছেন। ভক্তেরা দুই-একটি গান শুনিলেন। গান নরেন্দ্রের ভাল লাগিয়াছে। তিনি গায়ককে বলিলেন, ‘আবার গাও।’
শ্রীরামকৃষ্ণ—থাক্ থাক্, আর কাজ নাই, পয়সা কোথায়? (নরেন্দ্রের প্রতি) তুই তো বললি!
ভক্ত (সহাস্যে)—মহাশয়, আপনাকে আমীর ঠাওরেছে; আপনি তাকিয়া ঠেসান দিয়া বসিয়া আছেন—(সকলের হাস্য)।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিয়া)—ব্যারাম হয়েছে, ভাবতে পারে।
হাজরার অহংকারের কথা পড়িল। কোনও কারণে দক্ষিণেশ্বরের কালীবাটী ত্যাগ করিয়া হাজরার চলিয়া আসিতে হইয়াছিল।
নরেন্দ্র—হাজরা এখন মানছে, তার অহংকার হয়েছিল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও-কথা বিশ্বাস করো না। দক্ষিণেশ্বরে আবার আসবার জন্য ওরূপ কথা বলছে। (ভক্তদিগকে) নরেন্দ্র কেবল বলে, ‘হাজরা খুব লোক।’
নরেন্দ্র—এখনও বলি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেন? এত সব শুনলি।
নরেন্দ্র—দোষ একটু,—কিন্তু গুণ অনেকটা।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নিষ্ঠা আছে বটে।
“সে আমায় বলে, এখন তোমার আমাকে ভাল লাগছে না,—কিন্তু পরে আমাকে তোমায় খুঁজতে হবে। শ্রীরামপুর থেকে একটি গোঁসাই এসেছিল, অদ্বৈত বংশ। ইচ্ছা, ওখানে একরাত্রি দুরাত্রি থাকে। আমি যত্ন করে তাকে থাকতে বললুম। হাজরা বলে কি, ‘খাজাঞ্চীর কাছে ওকে পাঠাও’। এ-কথার মানে এই যে, দুধটুধ পাছে চায়, তাহলে হাজরার ভাগ থেকে কিছু দিতে হয়। আমি বললুম,—তবে রে শালা! গোঁসাই বলে আমি ওর কাছে সাষ্টাঙ্গ হই, আর তুই সংসারে থেকে কামিনী-কাঞ্চন লয়ে নানা কাণ্ড করে—এখন একটু জপ করে এত অহংকার হয়েছে! লজ্জা করে না!
“সত্ত্বগুণে ঈশ্বরকে পাওয়া যায়; রজঃ, তমোগুণে ঈশ্বর থেকে তফাত করে। সত্ত্বগুণকে সাদা রঙের সঙ্গে উপমা দিয়েছে, রজোগুণকে লাল রঙের সঙ্গে, আর তমোগুণকে কালো রঙের সঙ্গে। আমি একদিন হাজরাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি বল কার কত সত্ত্বগুণ হয়েছে। সে বললে, ‘নরেন্দ্রের ষোল আনা; আর আমার একটাকা দুইআনা।’ জিজ্ঞাসা করলাম, আমার কত হয়েছে? তা বললে, তোমার এখনও লালচে মারছে,—তোমার বার আনা। (সকলের হাস্য)
“দক্ষিণেশ্বরে বসে হাজরা জপ করত। আবার ওরই ভিতর থেকে দালালির চেষ্টা করত! বাড়িতে কয় হাজার টাকা দেনা আছে—সেই দেনা শুধতে হবে। রাঁধুনী বামুনদের কথায় বলেছিল, ও-সব লোকের সঙ্গে আমরা কি কথা কই!”
[কামনা ঈশ্বরলাভের বিঘ্ন—ঈশ্বর বালকস্বভাব]
“কি জানো, একটু কামনা থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায় না। ধর্মের সূক্ষ্ম গতি! ছুঁচে সুতা পরাচ্ছ—কিন্তু সুতার ভিতর একটু আঁস থাকলে ছুঁচের ভিতর প্রবেশ করবে না।
“ত্রিশ বছর মালা জপে, তবু কেন কিছু হয় না? ডাকুর ঘা হলে ঘুঁটের ভাবরা দিতে হয়। না হলে শুধু ঔষধে আরাম হয় না।
“কামনা থাকতে, যত সাধনা কর না কেন, সিদ্ধিলাভ হয় না। তবে একটি কথা আছে—ঈশ্বরের কৃপা হলে, ঈশ্বরের দয়া হলে একক্ষণে সিদ্ধিলাভ করতে পারে। যেমন হাজার বছরের অন্ধকার ঘর, হঠাৎ কেউ যদি প্রদীপ আনে, তাহলে একক্ষণে আলো হয়ে যায়!
“গরিবের ছেলে বড় মানুষের চোখে পড়ে গেছে। তার মেয়ের সঙ্গে তাকে বিয়ে দিলে। অমনি গাড়িঘোড়া, দাসদাসী, পোশাক, আসবাব, বাড়ি সব হয়ে গেল!”
একজন ভক্ত—মহাশয়, কৃপা কিরূপে হয়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঈশ্বর বালকস্বভাব। যেমন কোন ছেলে কোঁচড়ে রত্ন লয়ে বসে আছে! কত লোক রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছে। অনেকে তার কাছে রত্ন চাচ্ছে। কিন্তু সে কাপড়ে হাত চেপে মুখ ফিরিয়ে বলে, না আমি দেব না। আবার হয়ত যে চায়নি, চলে যাচ্ছে, পেছনে পেছনে দৌড়ে গিয়ে সেধে তাকে দিয়ে ফেলে!
[ত্যাগ—তবে ঈশ্বরলাভ—পূর্বকথা—সেজোবাবুর ভাব]
শ্রীরামকৃষ্ণ—ত্যাগ না হলে ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।
“আমার কথা লবে কে? আমি সঙ্গী খুঁজছি,—আমার ভাবের লোক। খুব ভক্ত দেখলে মনে হয়, এই বুঝি আমার ভাব নিতে পারবে। আবার দেখি, সে আর-একরকম হয়ে যায়!
“একটা ভূত সঙ্গী খুঁজছিল। শনি মঙ্গলবারে অপঘাত-মৃত্যু হলে ভূত হয়। ভূতটা, যেই দেখে কেউ শনি মঙ্গলবারে ওইরকম করে মরছে, অমনি দৌড়ে যায়। মনে করে, এইবার বুঝি আমার সঙ্গী হল। কিন্তু কাছেও যাওয়া, আর সে লোকটা দাঁড়িয়ে উঠেছে। হয়তো ছাদ থেকে পড়ে অজ্ঞান হয়েছে, আবার বেঁচে উঠেছে।
“সেজোবাবুর ভাব হল। সর্বদাই মাতালের মতো থাকে—কোনও কাজ করতে পারে না। তখন সবাই বলে, এরকম হলে বিষয় দেখবে কে? ছোট ভট্চার্জি নিশ্চয় কোনও তুক্ করেছে।”
[নরেন্দ্রের বেহুঁশ হওয়া—গুরুশিষ্যের দুটি গল্প]
“নরেন্দ্র যখন প্রথম প্রথম আসে, ওর বুকে হাত দিতে বেহুঁশ হয়ে গেল। তারপর চৈতন্য হলে কেঁদে বলতে লাগল, ওগো আমায় এমন করলে কেন? আমার যে বাবা আছে, আমার যে মা আছে গো! ‘আমার’, ‘আমার’ করা, এটি অজ্ঞান থেকে হয়।
“গুরু শিষ্যকে বললেন, সংসার মিথ্যা; তুই আমার সঙ্গে চলে আয়। শিষ্য বললে, ঠাকুর এরা আমায় এত ভালবাসে—আমার বাপ, আমার মা, আমার স্ত্রী—এদের ছেড়ে কেমন করে যাব। গুরু বললেন, তুই ‘আমার’ ‘আমার’ করছিস বটে, আর বলছিস ওরা ভালবাসে, কিন্তু ও-সব ভুল। আমি তোকে একটা ফন্দি শিখিয়ে দিচ্ছি, সেইটি করিস, তাহলে বুঝবি সত্য ভালবাসে কি না! এই বলে একটা ঔষধের বড়ি তার হাতে দিয়ে বললেন, এইটি খাস, মড়ার মতন হয়ে যাবি! তোর জ্ঞান যাবে না, সব দেখতে শুনতে পাবি। তারপর আমি গেলে তোর ক্রমে ক্রমে পূর্বাবস্থা হবে।
“শিষ্যটি ঠিক ওইরূপ করলে। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গেল। মা, স্ত্রী, সকলে আছড়া-পিছড়ি করে কাঁদছে। এমন সময় একটি ব্রাহ্মণ এসে বললে, কি হয়েছে গা? তারা সকলে বললে, এ ছেলেটি মারা গেছে। ব্রাহ্মণ মরা মানুষের হাত দেখে বললেন, সে কি, এ তো মরে নাই। আমি একটি ঔষধ দিচ্ছি, খেলেই সব সেরে যাবে! বাড়ির সকলে তখন যেন হাতে স্বর্গ পেলে। তখন ব্রাহ্মণ বললেন, তবে একটি কথা আছে। ঔষধটি আগে একজনের খেতে হবে, তারপর ওর খেতে হবে। যিনি আগে খাবেন, তাঁর কিন্তু মৃত্যু হবে। এর তো অনেক আপনার লোক আছে দেখছি, কেউ না কেউ অবশ্য খেতে পারে। মা কি স্ত্রী এঁরা খুব কাঁদছেন, এঁরা অবশ্য পারেন।
“তখন তারা সব কান্না থামিয়ে, চুপ করে রহিল। মা বললেন, তাই তো এই বৃহৎ সংসার, আমি গেলে, কে এই সব দেখবে শুনবে, এই বলে ভাবতে লাগলেন। স্ত্রী এইমাত্র এই বলে কাঁদছিল—‘দিদি গো আমার কি হল গো!’ সে বললে, তাই তো, ওঁর যা হবার হয়ে গেছে। আমার দুটি-তিনটি নাবালক ছেলেমেয়ে—আমি যদি যাই এদের কে দেখবে।
“শিষ্য সব দেখছিল শুনছিল। সে তখন দাঁড়িয়ে উঠে পড়ল; আর বললে, গুরুদেব চলুন, আপনার সঙ্গে যাই। (সকলের হাস্য)
“আর-একজন শিষ্য গুরুকে বলেছিল, আমার স্ত্রী বড় যত্ন করে, ওর জন্য গুরুদেব যেতে পারছি না। শিষ্যটি হঠযোগ করত। গুরু তাকেও একটি ফন্দি শিখিয়ে দিলেন। একদিন তার বাড়িতে খুব কান্নাকাটি পড়েছে। পাড়ার লোকেরা এসে দেখে হঠযোগী ঘরে আসনে বসে আছে—এঁকে বেঁকে, আড়ষ্ট হয়ে। সব্বাই বুঝতে পারলে, তার প্রাণবায়ু বেরিয়ে গেছে। স্ত্রী আছড়ে কাঁদছে, ‘ওগো আমাদের কি হল গো—ওগো তুমি আমাদের কি করে গেলে গো—ওগো দিদি গো, এমন হবে তা জানতাম না গো!’ এদিকে আত্মীয় বন্ধুরা খাট এনেছে, ওকে ঘর থেকে বার করছে।
“এখন একটি গোল হল। এঁকে বেঁকে আড়ষ্ট হয়ে থাকাতে সে দ্বার দিয়ে বেরুচ্ছে না। তখন একজন প্রতিবেশী দৌড়ে একটি কাটারি লয়ে দ্বারের চৌকাঠ কাটতে লাগল। স্ত্রী অস্থির হয়ে কাঁদছিল, সে দুমদুম শব্দ শুনে দৌড়ে এল। এসে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞাসা করলে, ওগো কি হয়েছে গো! তারা বললে, ইনি বেরুচ্ছেন না, তাই চৌকাঠ কাটছি। তখন স্ত্রী বললে, ওগো, অমন কর্ম করো না গো।—আমি এখন রাঁড় বেওয়া হলুম। আমার আর দেখবার লোক কেউ নাই, কটি নাবালক ছেলেকে মানুষ করতে হবে! এ দোয়ার গেলে আর তো হবে না। ওগো, ওঁর যা হবার তা তো হয়ে গেছে—হাত-পা ওঁর কেটে দাও! তখন হঠযোগী দাঁড়িয়ে পড়ল। তার তখন ঔষধের ঝোঁক চলে গেছে। দাঁড়িয়ে বলছে, ‘তবে রে শালী, আমার হাত-পা কাটবে।’ এই বলে বাড়ি ত্যাগ করে গুরুর সঙ্গে চলে গেল। (সকলের হাস্য)
“অনেকে ঢঙ করে শোক করে। কাঁদতে হবে জেনে আগে নৎ খোলে আর আর গহনা সব খোলে; খুলে বাক্সর ভিতর চাবি দিয়ে রেখে দেয়। তারপর আছড়ে এসে পড়ে, আর কাঁদে, ‘ওগো দিদিগো, আমার কি হল গো’!”
৪৭.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – অবতার সম্বন্ধে শ্রীরামকৃষ্ণের সম্মুখে নরেন্দ্রাদির বিচার
নরেন্দ্র—Proof (প্রমাণ) না হলে কেমন করে বিশ্বাস করি যে, ঈশ্বর মানুষ হয়ে আসেন।
গিরিশ—বিশ্বাসই sufficient proof (যথেষ্ট প্রমাণ)। এই জিনিসটা এখানে আছে, এর প্রমাণ কি? বিশ্বাসই প্রমাণ।
একজন ভক্ত—External world (বহির্জগৎ) বাহিরে আছে ফিলসফার (দার্শনিকরা) কেউ Prove করতে পেরেছে? তবে বলেছে irresistible belief (বিশ্বাস)।
গিরিশ (নরেন্দ্রের প্রতি)—তোমার সম্মুখে এলেও তো বিশ্বাস করবে না! হয়তো বলবে, ও বলছে আমি ঈশ্বর, মানুষ হয়ে এসেছি, ও মিথ্যাবাদী ভণ্ড।
দেবতারা অমর এই কথা পড়িল।
নরেন্দ্র—তার প্রমাণ কই?
গিরিশ—তোমার সামনে এলেও তো বিশ্বাস করবে না!
নরেন্দ্র—অমর, past-ages-তে ছিল, প্রুফ চাই।
মণি পল্টুকে কি বলিতেছেন।
পল্টু (নরেন্দ্রের প্রতি, সহাস্যে)—অনাদি কি দরকার? অমর হতে গেলে অনন্ত হওয়া দরকার।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—নরেন্দ্র উকিলের ছেলে, পল্টু ডেপুটির ছেলে। (সকলের হাস্য)
সকলে একটু চুপ করিয়া আছেন।
যোগীন (গিরিশাদি ভক্তদের প্রতি সহাস্যে)—নরেন্দ্রের কথা ইনি (ঠাকুর) আর লন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—আমি একদিন বলছিলাম, চাতক আকাশের জল ছাড়া আর কিছু খায় না। নরেন্দ্র বললে, চাতক এ-জলও খায়। তখন মাকে বললুম, মা এ-সব কথা কি মিথ্যা হয়ে গেল! ভারী ভাবনা হল। একদিন আবার নরেন্দ্র এসেছে। ঘরের ভিতর কতকগুলি পাখি উড়ছিল দেখে বলে উঠল, ‘ওই! ওই!’ আমি বললাম, কি? ও বললে, ‘ওই চাতক! ওই চাতক!’ দেখি কতকগুলো চামচিকে। সেই থেকে ওর কথা আর লই না। (সকলের হাস্য)
[ঈশ্বর-রূপদর্শন কি মনের ভুল?]
শ্রীরামকৃষ্ণ—যদু মল্লিকের বাগানে নরেন্দ্র বললে, তুমি ঈশ্বরের রূপ-টুপ যা দেখ, ও মনের ভুল। তখন অবাক্ হয়ে ওকে বললাম, কথা কয় যে রে? নরেন্দ্র বললে, ও অমন হয়। তখন মার কাছে এসে কাঁদতে লাগলাম! বললাম, মা, এ কি হল! এ-সব কি মিছে? নরেন্দ্র এমন কথা বললে! তখন দেখিয়ে দিলে—চৈতন্য—অখণ্ড চৈতন্য—চৈতন্যময় রূপ। আর বললে, ‘এ-সব কথা মেলে কেমন করে যদি মিথ্যা হবে!’ তখন বলেছিলাম, ‘শালা, তুই আমায় অবিশ্বাস করে দিছলি! তুই আর আসিস নি!’
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ—শাস্ত্র ও ঈশ্বরের বাণী—Revelation]
আবার বিচার হইতে লাগিল। নরেন্দ্র বিচার করিতেছেন! নরেন্দ্রের বয়স এখন ২২ বত্সর চার মাস হইবে।
নরেন্দ্র (গিরিশ, মাস্টার প্রভৃতিকে)—শাস্ত্রই বা বিশ্বাস কেমন করে করি! মহানির্বাণতন্ত্র একবার বলছেন, ব্রহ্মজ্ঞান না হলে নরক হবে। আবার বলে, পার্বতীর উপাসনা ব্যতীত আর উপায় নাই! মনুসংহিতায় মনু লিখছেন মনুরই কথা। মোজেস লিখছেন পেন্ট্যাটিউক্, তাঁরই নিজের মৃত্যুর কথা বর্ণনা!
“সাংখ্য দর্শন বলছেন, ‘ঈশ্বরাসিদ্ধেঃ’। ঈশ্বর আছেন, এ প্রমাণ করবার জো নাই। আবার বলে, বেদ মানতে হয়, বেদ নিত্য।
“তা বলে এ-সব নাই, বলছি না! বুঝতে পারছি না, বুঝিয়ে দাও! শাস্ত্রের অর্থ যার যা মনে এসেছে তাই করেছে। এখন কোন্টা লব? হোয়াইট লাইট (শ্বেত আলো) রেড মীডিয়ম-এর (লাল কাচের) মধ্য দিয়ে এলে লাল দেখায়। গ্রীন্ মীডিয়ম-এর মধ্য দিয়ে এলে গ্রীন্ দেখায়।”
একজন ভক্ত—গীতা ভগবান বলেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—গীতা সব শাস্ত্রের সার। সন্ন্যাসীর কাছে আর কিছু না থাকে, গীতা একখানি ছোট থাকবে।
একজন ভক্ত—গীতা শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন!
নরেন্দ্র—শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, না ইয়ে বলেছেন!—
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ অবাক্ হইয়া নরেন্দ্রের এই কথা শুনিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এ-সব বেশ কথা হচ্ছে।
“শাস্ত্রের দুইরকম অর্থ—শব্দার্থ ও মর্মার্থ। মর্মার্থটুকু লতে হয়; যে অর্থ ঈশ্বরের বাণীর সঙ্গে মিলে। চিঠির কথা, আর যে ব্যক্তি চিঠি লিখেছে তার মুখের কথা, অনেক তফাত। শাস্ত্র হচ্ছে চিঠির কথা; ঈশ্বরের বাণী মুখের কথা। আমি মার মুখের কথার সঙ্গে না মিললে কিছুই লই না।”
আবার অবতারের কথা পড়িল।
নরেন্দ্র—ঈশ্বরে বিশ্বাস থাকলেই হল। তারপর তিনি কোথায় ঝুলছেন বা কি করছেন এ আমার দরকার নাই। অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড! অনন্ত অবতার!
‘অনন্ত ব্রহ্মাণ্ড’, ‘অনন্ত অবতার’ শুনিয়া শ্রীরামকৃষ্ণ হাতজোড় করিয়া নমস্কার করিলেন ও বলিতেছেন, ‘আহা!’
মণি ভবনাথকে কি বলিতেছেন।
ভবনাথ—ইনি বলেন, ‘হাতি যখন দেখি নাই, তখন সে ছুঁচের ভিতর যেতে পারে কিনা কেমন করে জানব? ঈশ্বরকে জানি না, অথচ তিনি মানুষ হয়ে অবতার হতে পারেন কিনা, কেমন করে বিচারের দ্বারা বুঝব!’
শ্রীরামকৃষ্ণ—সবই সম্ভব। তিনি ভেলকি লাগিয়ে দেন! বাজিকর গলার ভিতর ছুরি লাগিয়ে দেয়, আবার বার করে। ইট-পাটকেল খেয়ে ফেলে!
৪৭.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ ও কর্ম—তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা
ভক্ত—ব্রাহ্মসমাজের লোকেরা বলেন, সংসারের কর্ম করা কর্তব্য। এ-কর্ম ত্যাগ করলে হবে না।
গিরিশ—সুলভ সমাচারে ওইরকম লিখেছে, দেখলাম। কিন্তু ঈশ্বরকে জানবার জন্য যে সব কর্ম—তাই করে উঠতে পারা যায় না, আবার অন্য কর্ম!
শ্রীরামকৃষ্ণ ঈষৎ হাসিয়া মাস্টারের দিকে তাকাইয়া নয়নের দ্বারা ইঙ্গিত করিলেন, ‘ও যা বলছে তাই ঠিক’।
মাস্টার বুঝিলেন, কর্মকাণ্ড বড় কঠিন।
পূর্ণ আসিয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কে তোমাকে খবর দিলে!
পূর্ণ—সারদা।
শ্রীরামকৃষ্ণ (উপস্থিত মেয়ে ভক্তদের প্রতি)—ওগো একে (পূর্ণকে) একটু জলখাবার দাও তো।
এইবার নরেন্দ্র গান গাইবেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও ভক্তেরা শুনিবেন। নরেন্দ্র গাইতেছেন :
গান—পরবত পাথার ।
ব্যোমে জাগো রুদ্র উদ্যত বাজ ।
দেব দেব মহাদেব, কাল কাল মহাকাল,
ধর্মরাজ শঙ্কর শিব তার হর পাপ ।
গান—সুন্দর তোমার নাম দীনশরণ হে,
বহিছে অমৃতধার, জুড়ায় শ্রবণ, প্রাণরমণ হে ।
গান—বিপদভয় বারণ, যে করে ওরে মন, তাঁরে কেন ডাক না;
মিছে ভ্রমে ভুলে সদা, রয়েছ, ভবঘোরে মজি, একি বিড়ম্বনা ।
এ ধন জন, না রবে হেন তাঁরে যেন ভুল না,
ছাড়ি অসার, ভজহ সার, যাবে ভব যাতনা ।
এখন হিত বচন শোন, যতনে করি ধারণা;
বদন ভরি, নাম হরি, সতত কর ঘোষণা ।
যদি এ-ভবে পার হবে, ছাড় বিষয় বাসনা;
সঁপিয়ে তনু হৃদয় মন, তাঁর কর সাধনা ।
পল্টু—এই গানটি গাইবেন?
নরেন্দ্র—কোন্টি?
পল্টু—দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে,
কি ভয় সংসার শোক ঘোর বিপদ শাসনে।
নরেন্দ্র সেই গানটি গাহিতেছেন :
দেখিলে তোমার সেই অতুল প্রেম-আননে,
কি ভয় সংসার শোক ঘোর বিপদ শাসনে ।
অরুণ উদয়ে আঁধার যেমন যায় জগৎ ছাড়িয়ে,
তেমনি দেব তোমার জ্যোতিঃ মঙ্গলময় বিরাজিলে,
ভকত হৃদয় বীতশোক তোমার মধুর সান্ত্বনে ।
তোমার করুণা, তোমার প্রেম, হৃদয়ে প্রভু ভাবিলে,
উথলে হৃদয় নয়ন বারি রাখে কে নিবারিয়ে?
জয় করুণাময়, জয় করুণাময় তোমার প্রেম গাইয়ে,
যায় যদি যাক্ প্রাণ তোমার কর্ম সাধনে ।
মাস্টারের অনুরোধে আবার গাইতেছেন। মাস্টার ও ভক্তেরা অনেকে হাতজোড় করিয়া গান শুনিতেছেন।
গান—হরিরসমদিরা পিয়ে মম মানস মাতোরে ।
একবার লুটহ অবনীতল, হরি হরি বলি কাঁদ রে ।
(গতি কর কর বলে) ।
গভীর নিনাদে হরিনামে গগন ছাও রে,
নাচো হরি বলে দুবাহু তুলে, হরিনাম বিলাও রে ।
(লোকের দ্বারে দ্বারে) ।
হরিপ্রেমানন্দরসে অনুদিন ভাস রে,
গাও হরিনাম, হও পূর্ণকাম, নীচ বাসনা নাশ রে ॥
গান—চিন্তয় মম মানস হরি চিদঘন নিরঞ্জন ।
গান—চমত্কার অপার জগৎ রচনা তোমার ।
গান—গগনের থালে রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে ।
গান—সেই এক পুরাতনে, পুরুষ নিরঞ্জনে, চিত্ত সমাধান কর রে ।
নারাণের অনুরোধে আবার নরেন্দ্র গাইতেছেন :
এসো মা এসো মা, ও হৃদয়-রমা, পরাণ-পুতলী গো ।
হৃদয়-আসনে, হও মা আসীন, নিরখি তোরে গো ॥
আছি জন্মাবধি তোর মুখ চেয়ে,
জান মা জননী কি দুখ পেয়ে,
একবার হৃদয়কমল বিকাশ করিয়ে,
প্রকাশ তাহে আনন্দময়ী ॥
[শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিমন্দিরে—তাঁহার ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা]
নরেন্দ্র নিজের মনে গাইতেছেন :
নিবিড় আঁধারে মা তোর চমকে ও রূপরাশি ।
তাই যোগী ধ্যান ধরে হয়ে গিরিগুহাবাসী ॥
সমাধির এই গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইতেছেন।
নরেন্দ্র আর একবার সেই গানটি গাইতেছেন—
হরিরসমদিরা পিয়ে মম মানস মাতোরে ।
শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট। উত্তরাস্য হইয়া দেওয়ালে ঠেসান দিয়া পা ঝুলাইয়া তাকিয়ার উপর বসিয়া আছেন। ভক্তেরা চতুর্দিকে উপবিষ্ট।
ভাবাবিষ্ট হইয়া ঠাকুর মার সঙ্গে একাকী কথা কহিতেছেন। ঠাকুর বলিতেছেন—“এই বেলা খেয়ে যাব। তুই এলি? তুই কি গাঁট্রি বেঁধে বাসা পাকড়ে সব ঠিক করে এলি?”
ঠাকুর কি বলিতেছেন, মা তুই কি এলি? ঠাকুর আর মা কি অভেদ?
“এখন আমার কারুকে ভাল লাগছে না।”
“মা, গান কেন শুনব? ওতে তো মন খানিকটা বাইরে চলে যাবে!”
ঠাকুর ক্রমে ক্রমে আরও বাহ্যজ্ঞান লাভ করিতেছেন। ভক্তদের দিকে তাকাইয়া বলিতেছেন, “আগে কইমাছ জীইয়ে রাখা দেখে আশ্চর্য হতুম; মনে করতুম এরা কি নিষ্ঠুর, এদের শেষকালে হত্যা করবে! অবস্থা যখন বদলাতে লাগল তখন দেখি যে, শরীরগুলো খোল মাত্র! থাকলেও এসে যায় না, গেলেও এসে যায় না!”
ভবনাথ—তবে মানুষ হিংসা করা যায়!—মেরে ফেলা যায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, এ-অবস্থায় হতে পারে১। সে অবস্থা সকলের হয় না।—ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা।
“দুই-এক গ্রাম নেমে এলে তবে ভক্তি, ভক্ত ভাল লাগে!
“ঈশ্বরেতে বিদ্যা-অবিদ্যা দুই আছে। এই বিদ্যা মায়া ঈশ্বরের দিকে লয়ে যায়, অবিদ্যা মায়া ঈশ্বর থেকে মানুষকে তফাত করে লয়ে যায়। বিদ্যার খেলা—জ্ঞান, ভক্তি, দয়া, বৈরাগ্য। এই সব আশ্রয় করলে ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো যায়।
“আর-একধাপ উঠলেই ঈশ্বর—ব্রহ্মজ্ঞান! এ-অবস্থায় ঠিক বোধ হচ্চে—ঠিক দেখছি—তিনিই সব হয়েছেন। ত্যাজ্য-গ্রাহ্য থাকে না! কারু উপর রাগ করবার জো থাকে না।
“গাড়ি করে যাচ্ছি—বারান্দার উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে দেখলাম দুই বেশ্যা! দেখলাম সাক্ষাৎ ভগবতী—দেখে প্রণাম করলাম!
“যখন এই অবস্থা প্রথম হল, তখন মা-কালীকে পূজা করতে বা ভোগ দিতে আর পারলাম না। হলধারী আর হৃদে বললে, খাজাঞ্চী বলেছে, ভট্চাজ্জি ভোগ দিবেন না তো কি করবেন? আমি কুবাক্য বলেছে শুনে কেবল হাসতে লাগলাম, একটু রাগ হল না।
“এই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করে তারপর লীলা আস্বাদন করে বেড়াও। সাধু একটি শহরে এসে রঙ দেখে বেড়াচ্চে। এমন সময়ে তার এক আলাপী সাধুর সঙ্গে দেখা হল। সে বললে ‘তুমি যে ঘুরে ঘুরে আমোদ করে বেড়াচ্চো, তল্পিতল্পা কই? সেগুলি তো চুরি করে লয়ে যায় নাই?’ প্রথম সাধু বললে, ‘না মহারাজ, আগে বাসা পাকড়ে গাঁট্রি-ওঠরি ঠিকঠাক করে ঘরে রেখে, তালা লাগিয়ে তবে শহরের রঙ দেখে বেড়াচ্চি’।” (সকলের হাস্য)
ভবনাথ—এ খুব উঁচু কথা।
মণি (স্বগত)—ব্রহ্মজ্ঞানের পর লীলা-আস্বাদন! সমাধির পর নিচে নামা!
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারাদির প্রতি)—ব্রহ্মজ্ঞান কি সহজে হয় গা? মনের নাশ না হলে হয় না। গুরু শিষ্যকে বলেছিল, তুমি আমায় মন দাও, আমি তোমায় জ্ঞান দিচ্ছি। ন্যাংটা বলত, ‘আরে মন বিলাতে নাহি’!১ …ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে [গীতা, ২।২০]
[Biology—‘Natural law’ in the Spiritual world]
“এ অবস্থায় কেবল হরিকথা ভাল লাগে; আর ভক্তসঙ্গ।
(রামের প্রতি)—“তুমি তো ডাক্তার,—যখন রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে এক হয়ে যাবে তখনই তো কাজ হবে। তেমনি এ অবস্থায় অন্তরে-বাহিরে ঈশ্বর। সে দেখবে তিনিই দেহ মন প্রাণ আত্মা!”
মণি (স্বগত)—Assimilation!
শ্রীরামকৃষ্ণ—ব্রহ্মজ্ঞানের অবস্থা! মনের নাশ হলেই হয়। মনের নাশ হলেই ‘অহং’ নাশ,—যেটা ‘আমি’ ‘আমি’ করছে। এটি ভক্তি পথেও হয়, আবার জ্ঞানপথে অর্থাৎ বিচারপথেও হয়। ‘নেতি নেতি’ অর্থাৎ ‘এ-সব মায়া, স্বপ্নবৎ’ এই বিচার জ্ঞানীরা করে। এই জগৎ ‘নেতি’ ‘নেতি’—মায়া। জগৎ যখন উড়ে গেল, বাকী রইল কতকগুলি জীব—‘আমি’ ঘট মধ্যে রয়েছে!
“মনে কর দশটা জলপূর্ণ ঘট আছে, তার মধ্যে সূর্যের প্রতিবিম্ব হয়েছে। কটা সূর্য দেখা যাচ্ছে?”
ভক্ত—দশটা প্রতিবিম্ব। আর একটা সত্য সূর্য তো আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—মনে কর, একটা ঘট ভেঙে দিলে, এখন কটা সূর্য দেখা যায়?
ভক্ত—নয়টা; একটা সত্য সূর্য তো আছেই।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আচ্ছা, নয়টা ঘট ভেঙে দেওয়া গেল, কটা সূর্য দেখা যাবে?
ভক্ত—একটা প্রতিবিম্ব সূর্য। একটা সত্য সূর্য তো আছেই।
শ্রীরামকৃষ্ণ (গিরিশের প্রতি)—শেষ ঘট ভাঙলে কি থাকে?
গিরিশ—আজ্ঞা, ওই সত্য সূর্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ—না। কি থাকে তা মুখে বলা যায় না। যা আছে তাই আছে। প্রতিবিম্ব সূর্য না থাকলে সত্য সূর্য আছে কি করে জানবে! সমাধিস্থ হলে অহং তত্ত্ব নাশ হয়। সমাধিস্থ ব্যক্তি নেমে এলে কি দেখেছে মুখে বলতে পারে না!
৪৭.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তদিগকে আশ্বাস প্রদান ও অঙ্গীকার
অনেকক্ষণ সন্ধ্যা হইয়া গিয়াছে। বলরামের বৈঠকখানায় দীপালোক জ্বলিতেছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এখনও ভাবস্থ, ভক্তজন পরিবৃত হইয়া আছেন। ভাবে বলিতেছেন—
“এখানে আর কেউ নাই, তাই তোমাদের বলছি,—আন্তরিক ঈশ্বরকে যে জানতে চাইবে তারই হবে, হবেই হবে! যে ব্যাকুল, ঈশ্বর বই আর কিছু চায় না, তারই হবে।
“এখানকার যারা লোক (অন্তরঙ্গ ভক্তেরা) তারা সব জুটে গেছে। আর সব এখন যারা যাবে তারা বাহিরের লোক। তারাও এখন মাঝে মাঝে যাবে। (মা) তাদের বলে দেবে, ‘এই করো, এইরকম করে ঈশ্বরকে ডাকো’।”
[ঈশ্বরই গুরু—জীবের একমাত্র মুক্তির উপায়]
“কেন ঈশ্বরের দিকে (জীবের) মন যায় না? ঈশ্বরের চেয়ে তাঁর মহামায়ার আবার জোর বেশি। জজের চেয়ে প্যায়দার ক্ষমতা বেশি। (সকলের হাস্য)
“নারদকে রাম বললেন, নারদ, আমি তোমার স্তবে বড় প্রসন্ন হয়েছি; আমার কাছে কিছু বর লও! নারদ বললেন, রাম! তোমার পাদপদ্মে যেন আমার শুদ্ধাভক্তি হয়, আর যেন তোমার ভুবনমোহিনী মায়ায় মুগ্ধ না হই। রাম বললেন, তথাস্তু, আর কিছু বর লও! নারদ বললেন, রাম আর কিছু বর চাই না।
“এই ভুবনমোহিনী মায়ায় সকলে মুগ্ধ। ঈশ্বর দেহধারণ করেছেন—তিনিও মুগ্ধ হন। রাম সীতার জন্য কেঁদে কেঁদে বেড়িয়েছিলেন। ‘পঞ্চভূতের ফাঁদে ব্রহ্ম পড়ে কাঁদে।’
“তবে একটি কথা আছে,—ঈশ্বর মনে করলেই মুক্ত হন!”
ভবনাথ—গার্ড (রেলের গাড়ির) নিজে ইচ্ছা করে রেলের গাড়ির ভিতর আপনাকে রুদ্ধ করে; আবার মনে করলেই নেমে পড়তে পারে!
শ্রীরামকৃষ্ণ—ঈশ্বরকোটি—যেমন অবতারাদি—মনে করলেই মুক্ত হতে পারে। যারা জীবকোটি তারা পারে না। জীবরা কামিনী-কাঞ্চনে বদ্ধ। ঘরের দ্বার-জানলা, ইস্কুরু দিয়ে আঁটা, বেরুবে কেমন করে?
ভবনাথ (সহাস্যে)—যেমন রেলের থার্ডক্লাস্ প্যাসেঞ্জার-রা (তৃতীয় শ্রেণীর আরোহীরা) চাবিবন্ধ, বেরুবার জো নাই!
গিরিশ—জীব যদি এরূপ আষ্টেপৃষ্ঠে বদ্ধ, তার এখন উপায়?
শ্রীরামকৃষ্ণ—তবে গুরুরূপ হয়ে ঈশ্বর স্বয়ং যদি মায়াপাশ ছেদন করেন তাহলে আর ভয় নাই।
ঠাকুর কি ইঙ্গিত করিতেছেন যে, তিনি নিজে জীবের মায়াপাশ ছেদন করতে দেহধারণ করে, গুরুরূপ হয়ে এসেছেন?