[নরেন্দ্র, মাস্টার, যোগীন, বাবুরাম, রাম, ভবনাথ, বলরাম, চুনি]
শুক্রবার (১২ই বৈশাখ, ১২৯২) বৈশাখের শুক্লা দশমী, ২৪শে এপ্রিল, ১৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দ। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আজ কলিকাতায় আসিয়াছেন। মাস্টার আন্দাজ বেলা একটার সময় বলরামের বৈঠকখানায় গিয়া দেখেন, ঠাকুর নিদ্রিত। দু-একটি ভক্ত কাছে বিশ্রাম করিতেছেন।
মাস্টার একপার্শ্বে বসিয়া সেই সুপ্ত বালক-মূর্তি দেখিতেছেন। ভাবিতেছেন, কি আশ্চর্য, এই মহাপুরুষ, ইনিও প্রাকৃত লোকের ন্যায় নিদ্রায় অভিভূত হইয়া শুইয়া আছেন। ইনিও জীবের ধর্ম স্বীকার করিয়াছেন।
মাস্টার আস্তে আস্তে একখানি পাখা লইয়া হাওয়া করিতেছেন। কিছুক্ষণ পরে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের নিদ্রাভঙ্গ হইল। এলোথেলো হইয়া তিনি উঠিয়া বসিলেন। মাস্টার ভূমিষ্ঠ হইয়া তাঁহাকে প্রণাম ও তাঁহার পদধূলি গ্রহণ করিলেন।
[শ্রীরামকৃষ্ণের প্রথম অসুখের সঞ্চার—এপ্রিল ১৮৮৫]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি সস্নেহে)—ভাল আছ? কে জানে বাপু! আমার গলায় বিচি হয়েছে। শেষ রাত্রে বড় কষ্ট হয়। কিসে ভাল হয় বাপু? (চিন্তিত হইয়া)—আমের অম্বল করেছিল, সব একটু একটু খেলুম। (মাস্টারের প্রতি)—তোমার পরিবার কেমন আছে? সেদিন কাহিল দেখলুম; ঠাণ্ডা একটু একটু দেবে।
মাস্টার—আজ্ঞা, ডাব-টাব?
শ্রীরামকৃষ্ণ—হাঁ, মিছরির সরবৎ খাওয়া ভাল।
মাস্টার—আমি রবিবার বাড়ি গিয়েছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—বেশ করেছ। বাড়িতে থাকা তোমার সুবিধে। বাপ-টাপ সকলে আছে, তোমায় সংসার তত দেখতে হবে না।
কথা কহিতে কহিতে ঠাকুরের মুখ শুকাইতে লাগিল। তখন বালকের ন্যায় জিজ্ঞাসা করিতেছেন, (মাস্টারের প্রতি)—আমার মুখ শুকুচ্চে। সবাই-এর কি মুখ শুকুচ্চে?
মাস্টার—যোগীনবাবু, তোমার কি মুখ শুকুচ্চে?
যোগীন্দ্র—না; বোধ হয়, ওঁর গরম হয়েছে।
এঁড়েদার যোগীন ঠাকুরের অন্তরঙ্গ; একজন ত্যাগী ভক্ত।
ঠাকুর এলোথেলো হয়ে বসে আছেন। ভক্তেরা কেহ কেহ হাসিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—যেন মাই দিতে বসেছি। (সকলের হাস্য) আচ্ছা, মুখ শুকুচ্চে, তা ন্যাশপাতি খাব? কি জামরুল?
বাবুরাম—তাই বরং আনি গে—জামরুল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোর আর রৌদ্রে গিয়ে কাজ নাই।
মাস্টার পাখা করিতেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—থাক, তুমি অনেকক্ষণ—
মাস্টার—আজ্ঞা, কষ্ট হচ্চে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সস্নেহে)—হচ্চে না?
মাস্টার নিকটবর্তী একটি স্কুলে অধ্যাপনা কার্য করেন। তিনি একটার সময় পড়ান হইতে কিঞ্চিৎ অবসর পাইয়া আসিয়াছিলেন। এইবার স্কুলে আবার যাইবার জন্য গাত্রোত্থান করিলেন ও ঠাকুরের পাদবন্দনা করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—এক্ষণই যাবে?
একজন ভক্ত—স্কুলের এখনও ছুটি হয় নাই। উনি মাঝে একবার এসেছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—যেমন গিন্নি—সাত-আটটি ছেলে বিয়েন—সংসারে রাতদিন কাজ—আবার ওর মধ্যে এক-একবার এসে স্বামীর সেবা করে যায়। (সকলের হাস্য)
৪৬.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীযুক্ত বলরামের বাটীতে অন্তরঙ্গসঙ্গে
চারটের পর স্কুলের ছুটি হইল, মাস্টার বলরামবাবুর বাহিরের ঘরে আসিয়া দেখেন, ঠাকুর সহাস্যবদন, বসিয়া আছেন। সংবাদ পাইয়া একে একে ভক্তগণ আসিয়া জুটিতেছেন। ছোট নরেন ও রাম আসিয়াছেন। নরেন্দ্র আসিয়াছেন। মাস্টার প্রণাম করিয়া আসন গ্রহণ করিলেন। বাটীর ভিতর হইতে বলরাম থালায় করিয়া ঠাকুরের জন্য মোহনভোগ পাঠাইয়াছেন, কেন না, ঠাকুরের গলায় বিচি হইয়াছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মোহনভোগ দেখিয়া, নরেন্দ্রের প্রতি)—ওরে মাল এসেছে! মাল! মাল! খা! খা! (সকলের হাস্য)
ক্রমে বেলা পড়িতে লাগিল। ঠাকুর গিরিশের বাড়ি যাইবেন, সেখানে আজ উত্সব। ঠাকুরকে লইয়া গিরিশ উত্সব করিবেন। ঠাকুর বলরামের দ্বিতল ঘর হইতে নামিতেছেন। সঙ্গে মাস্টার পশ্চাতে আরও দু-একটি ভক্ত। দেউড়ির কাছে আসিয়া দেখেন, একটি হিন্দুস্থানী ভিখারী গান গাহিতেছে। রামনাম শুনিয়া ঠাকুর দাঁড়াইলেন। দক্ষিণাস্য। দেখিতে দেখিতে মন অন্তর্মুখ হইতেছে। এইরূপভাবে খানিকক্ষণ দাঁড়াইয়া রহিলেন; মাস্টারকে বলিলেন, “বেশ সুর।” একজন ভক্ত ভিক্ষুককে চারিটি পয়সা দিলেন।
ঠাকুর বোসপাড়ার গলিতে প্রবেশ করিয়াছেন। হাসিতে হাসিতে মাস্টারকে বললেন, “হ্যাঁগা, কি বলে? ‘পরমহংসের ফৌজ আসছে’? শালারা বলে কি।” (সকলের হাস্য)
৪৬.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – অবতার ও সিদ্ধ-পুরুষের প্রভেদ—মহিমা ও গিরিশের বিচার
ভক্তসঙ্গে ঠাকুর গিরিশের বাহিরের ঘরে প্রবেশ করিলেন। গিরিশ অনেকগুলি ভক্তকে নিমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। তাঁহারা অনেকেই সমবেত হইয়াছেন। ঠাকুর আসিয়াছেন শুনিয়া সকলে দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন। ঠাকুর সহাস্যবদনে আসন গ্রহণ করিলেন। ভক্তেরাও সকলে বসিলেন। গিরিশ, মহিমাচরণ, রাম, ভবনাথ ইত্যাদি অনেক ভক্ত বসিয়াছিলেন। এ ছাড়া ঠাকুরের সঙ্গে অনেকে আসিলেন, বাবুরাম, যোগীন, দুই নরেন্দ্র, চুনি, বলরাম ইত্যাদি।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণের প্রতি)—গিরিশ ঘোষকে বললুম, তোমার নাম করে, ‘একজন লোক আছে—গভীর, তোমার এক হাঁটু জল’। তা এখন যা বলেছি মিলিয়ে দাও দেখি। তোমরা দুজনে বিচার করো, কিন্তু রফা করো না। (সকলের হাস্য)
মহিমাচরণ ও গিরিশের বিচার হইতে লাগিল। একটু আরম্ভ হইতে না হইতে রাম বলিলেন, “ও-সব থাক—কীর্তন হোক।”
শ্রীরামকৃষ্ণ (রামের প্রতি)—না, না; এর অনেক মানে আছে। এরা ইংলিশম্যান, এরা কি বলে দেখি।
মহিমাচরণের মত—সকলেই শ্রীকৃষ্ণ হতে পারে, সাধন করিতে পারিলেই হইল। গিরিশের মত—শ্রীকৃষ্ণ অবতার, মানুষ হাজার সাধন করুক, অবতারের মতো হইতে পারিবে না।
মহিমাচরণ—কিরকম জানেন? যেমন বেলগাছটা আমগাছ হতে পারে প্রতিবন্ধক পথ থেকে গেলেই হল। যোগের প্রক্রিয়া দ্বারা প্রতিবন্ধক চলে যায়।
গিরিশ—তা মশাই যাই বলুন, যোগের প্রক্রিয়াই বলুন আর যাই বলুন, সেটি হতে পারে না। কৃষ্ণই কৃষ্ণ হতে পারেন। যদি সেই সব ভাব, মনে করুন রাধার ভাব কারু ভিতরে থাকে, তবে সে ব্যক্তি সেই-ই; অর্থাৎ সে ব্যক্তি রাধা স্বয়ং। শ্রীকৃষ্ণের সমস্ত ভাব যদি কারু ভিতর দেখতে পাই, তখন বুঝতে হবে, শ্রীকৃষ্ণকেই দেখছি।
মহিমাচরণ বিচার বেশিদূর লইয়া যাইতে পারিলেন না। অবশেষে এক-রকম গিরিশের কথায় সায় দিলেন।
মহিমাচরণ (গিরিশের প্রতি)—হাঁ মহাশয়, দুই-ই সত্য। জ্ঞানপথ সেও তাঁর ইচ্ছা; আবার প্রেমভক্তি, তাঁর ইচ্ছা। ইনি যেমন বলেন, ভিন্ন পথ দিয়ে এক জায়গাতেই পৌঁছানো যায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি একান্তে)—কেমন, ঠিক বলছি না?
মহিমা—আজ্ঞা, যা বলেছেন। দুই-ই সত্য।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আপনি দেখলে, ওর (গিরিশের) কি বিশ্বাস! জল খেতে ভুলে গেল। আপনি যদি না মানতে, তাহলে টুঁটি ছিঁড়ে খেত, যেমন কুকুরে মাংস খায়। তা বেশ হল। দুজনের পরিচয় হল, আর আমারও অনেকটা জানা হল।
৪৬.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর কীর্তনানন্দে
কীর্তনিয়া দলবলের সহিত উপস্থিত। ঘরের মাঝখানে বসিয়া আছে। ঠাকুরের ইঙ্গিত হইলেই কীর্তন আরম্ভ হয়। ঠাকুর অনুমতি দিলেন।
রাম (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আপনি বলুন এরা কি গাইবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আমি কি বলব?—(একটু চিন্তা করিয়া) আচ্ছা, অনুরাগ।
কীর্তনিয়া পূর্বরাগ গাইতেছেন :
আরে মোর গোরা দ্বিজমণি ।
রাধা রাধা বলি কান্দে, লোটায় ধরণী ॥
রাধানাম জপে গোরা পরম যতনে ।
সুরধুনী ধারা বহে অরুণ নয়নে ॥
ক্ষণে ক্ষণে গোরা অঙ্গ ভূমে গড়ি যায় ।
রাধানাম বলি ক্ষণে ক্ষণে মুরছায় ॥
পুলকে পুরল তনু গদ গদ বোল ।
বাসু কহে গোরা কেন এত উতরোল ॥
কীর্তন চলিতে লাগিল। যমুনাতটে প্রথম কৃষ্ণদর্শন অবধি শ্রীমতীর অবস্থা সখীগণ বলিতেছেন :
ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার, তিলে তিলে আইসে যায় ।
মন উচাটন নিঃশ্বাস সঘন, কদম্ব কাননে চায় ॥
(রাই এমন কেনে বা হৈল) ।
গুরু দুরু জন, ভয় নাহি মন, কোথা বা কি দেব পাইল ॥
সদাই চঞ্চল, বসন অঞ্চল, সম্বরণ নাহি করে ।
বসি বসি থাকি, উঠয়ে চমকি, ভূষণ খসিয়া পড়ে ॥
বয়সে কিশোরী রাজার কুমারী, তাহে কুলবধূ বালা ।
কিবা অভিলাষে, আছয়ে লালসে, না বুঝি তাহার ছলা ॥
তাহার চরিতে, হেন বুঝি চিতে, হাত বাড়াইল চান্দে ।
চণ্ডীদাস কয়, করি অনুনয়, ঠেকেছে কালিয়া ফান্দে ॥
কীর্তন চলিতে লাগিল—শ্রীমতীকে সখীগণ বলিতেছেন :
কহ কহ সুবদনী রাধে! কি তোর হইল বিয়াধে ॥
কেন তোরে আনমন দেখি । কাহে নখে ক্ষিতি তলে লিখি ॥
হেমকান্তি ঝামর হৈল । রাঙ্গাবাস খসিয়া পড়িল ॥
আঁখিযুগ অরুণ হইল । মুখপদ্ম শুকাইয়া গেল ॥
এমন হইল কি লাগিয়া । না কহিলে ফাটি যায় হিয়া ॥
এত শুনি কহে ধনি রাই । শ্রীযদুনন্দন মুখ চাই ॥
কীর্তনিয়া আবার গাইল—শ্রীমতী বংশীধ্বনি শুনিয়া পাগলের ন্যায় হইয়াছেন। সখীগণের প্রতি শ্রীমতীর উক্তি :
কদম্বের বনে, থাকে কোন্ জনে, কেমনে শবদ্ আসি ।
একি আচম্বিতে, শ্রবণের পথে, মরমে রহল পশি ॥
সান্ধায়ে মরমে, ঘুচায়া ধরমে, করিল পাগলি পারা ।
চিত স্থির নহে, শোয়াস বারহে, নয়নে বহয়ে ধারা ॥
কি জানি কেমন, সেই কোন জন, এমন শবদ্ করে ।
না দেখি তাহারে, হৃদয় বিদরে, রহিতে না পারি ঘরে ॥
পরাণ না ধরে, কন কন করে, রহে দরশন আশে ।
যবহুঁ দেখিবে, পরাণ পাইবে, কহয়ে উদ্ধব দাসে ॥
গান চলিতে লাগিল। শ্রীমতীর কৃষ্ণদর্শন জন্য প্রাণ ব্যাকুল হইয়াছে। শ্রীমতী বলিতেছেন :
পহিলে শুনিনু, অপরূপ ধ্বনি, কদম্ব কানন হৈতে ।
তারপর দিনে, ভাটের বর্ণনে, শুনি চমকিত চিতে ॥
আর একদিন, মোর প্রাণ-সখী কহিলে যাহার নাম,
(আহা সকল মাধুর্যময় কৃষ্ণ নাম) ।
গুণিগণ গানে, শুনিনু শ্রবণে, তাহার এ গুণগ্রাম ॥
সহজে অবলা, তাহে কুলবালা, গুরুজন জ্বালা ঘরে ।
সে হেন নাগরে, আরতি বাঢ়য়ে, কেমনে পরাণ ধরে ।
ভাবিয়া চিন্তিয়া, মনে দঢ়াইনু, পরাণ রহিবার নয় ।
কহত উপায় কৈছে মিলয়ে, দাস উদ্ধবে কয় ॥
“আহা সকল মাধুর্যময় কৃষ্ণনাম!” এই কথা শুনিয়া ঠাকুর আর বসিতে পারিলেন না। একেবারে বাহ্যশূন্য, দণ্ডায়মান। সমাধিস্থ! ডানদিকে ছোট নরেন দাঁড়াইয়া। একটু প্রকৃতিস্থ হইয়া মধুর কণ্ঠে “কৃষ্ণ” “কৃষ্ণ”এই কথা সাশ্রুনয়নে বলিতেছেন। ক্রমে পুনর্বার আসন গ্রহণ করিলেন।
কীর্তনিয়া আবার গাইতেছেন। বিশাখা দৌড়িয়া গিয়া একখানি চিত্রপট আনিয়া শ্রীমতীর সম্মুখে ধরিলেন। চিত্রপটে সেই ভুবনরঞ্জনরূপ। শ্রীমতী পটদর্শনে বলিলেন, এই পটে যাঁকে দেখছি, তাঁকে যমুনাতটে দেখা অবধি আমার এই দশা হয়েছে।
কীর্তন—শ্রীমতীর উক্তি—
যে দেখেছি যমুনাতটে । সেই দেখি এই চিত্রপটে ॥
যার নাম কহিল বিশাখা । সেই এই পটে আছে লেখা ॥
যাহার মুরলী ধ্বনি । সেই বটে এই রসিকমণি ॥
আধমুখে যার গুণ গাঁথা । দূতীমুখে শুনি যার কথা ॥
এই মোর হরিয়াছে প্রাণ । ইহা বিনে কেহ নহে আন ॥
এত কহি মূরছি পড়য়ে । সখীগণ ধরিয়া তোলয়ে ॥
পুনঃ কহে পাইয়া চেতনে । কি দেখিনু দেখাও সে জনে ॥
সখীগণ করয়ে আশ্বাস । ভণে ঘনশ্যাম দাস ॥
ঠাকুর আবার উঠিলেন, নরেন্দ্রাদি সাঙ্গোপাঙ্গ লইয়া উচ্চ সংকীর্তন করিতেছেন :
(১)—যাদের হরি বলতে নয়ন ঝরে তারা তারা দুভাই এসেছে রে।
(যারা আপনি কেঁদে জগৎ কাঁদায়) (যারা মার খেয়ে প্রেম যাচে)
(যারা ব্রজের কানাই বলাই) (যারা ব্রজের মাখন চোর)
(যারা জাতির বিচার নাহি করে) (যারা আপামরে কোল দেয়)
(যারা আপনি মেতে জগৎ মাতায়) (যারা হরি হয়ে হরি বলে) ।
(যারা জগাই মাধাই উদ্ধারিল) (যারা আপন পর নাহি বাচে) ।
জীব তরাতে তারা দুভাই এসেছে রে । (নিতাই গৌর) ।
(২)—নদে টলমল টলমল করে, গৌরপ্রেমের হিল্লোলে রে।
ঠাকুর আবার সমাধিস্থ!
ভাব উপশম হইলে আবার আসন গ্রহণ করিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—কোন্ দিকে সুমুখ ফিরে বসেছিলাম, এখন মনে নাই।
৪৬.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণ ও নরেন্দ্র—হাজরার কথা—ছলরূপী নারায়ণ
ঠাকুর, ভাব উপশমের পর ভক্তসঙ্গে কথা কহিতেছেন।
নরেন্দ্র (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—হাজরা এখন ভাল হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুই জানিস নি, এমন লোক আছে, বগলে ইট, মুখে রাম রাম বলে।
নরেন্দ্র—আজ্ঞা না, সব জিজ্ঞাসা করলুম, তা সে বলে, ‘না’।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তার নিষ্ঠা আছে, একটু জপটপ করে। কিন্তু অমন!—গাড়োয়ানকে ভাড়া দেয় না!
নরেন্দ্র—আজ্ঞা না, সে বলে তো ‘দিয়েছি’—
শ্রীরামকৃষ্ণ—কোথা থেকে দেবে?
নরেন্দ্র—রামলাল টামলালের কাছ থেকে দিয়েছে, বোধ হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুই সব কথা জিজ্ঞাসা কি করেছিস?
“মাকে প্রার্থনা করেছিলাম, মা, হাজরা যদি ছল হয়, এখান থেকে সরিয়ে দাও। ওকে সেই কথা বলেছিলাম। ও কিছুদিন পরে এসে বলে, দেখলে আমি এখনও রয়েছি। (ঠাকুরের ও সকলের হাস্য) কিন্তু তারপরে চলে গেল।
“হাজরার মা রামলালকে দিয়ে বলে পাঠিয়েছিল, ‘হাজরাকে একবার রামলালের খুড়োমশায় যেন পাঠিয়ে দেন। আমি কেঁদে কেঁদে চোখে দেখতে পাই না।’ আমি হাজরাকে অনেক করে বললুম, বুড়ো মা, একবার দেখা দিয়ে এস; তা কোন মতে গেল না। তার মা শেষে কেঁদে কেঁদে মরে গেল।”
নরেন্দ্র—এবারে দেশে যাবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখন দেশে যাবে, ঢ্যামনা শালা! দূর দূর, তুই বুঝিস না। গোপাল বলেছে, সিঁথিতে হাজরা কদিন ছিল। তারা চাল ঘি সব জিনিস দিত। তা বলেছিল, এ ঘি এ চাল কি আমি খাই? ভাটপাড়ায় ঈশেনের সঙ্গে গিছল। ঈশেনকে নাকি বলেছে, বাহ্যে যাবার জল আনতে। এই বামুনরা সব রেগে গিছল।
নরেন্দ্র—জিজ্ঞাসা করেছিলুম, তা সে বলে, ঈশানবাবু এগিয়ে দিতে গিছল। আর ভাটপাড়ায় অনেক বামুনের কাছে মানও হয়েছিল!
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাসিতে হাসিতে)—ওইটুকু জপতপের ফল।
“আর কি জানো, অনেকটা লক্ষণে হয়। বেঁটে, ডোব কাটা কাটা গা, ভাল লক্ষণ নয়। অনেক দেরিতে জ্ঞান হয়।”
ভবনাথ—থাক্ থাক্—ও-সব কথায়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তা নয়। (নরেন্দ্রের প্রতি)—তুই নাকি লোক চিনিস, তাই তোকে বলছি। আমি হাজরাকে ও সকলকে কিরকম জানি, জানিস? আমি জানি, যেমন সাধুরূপী নারায়ণ, তেমনি ছলরূপী নারায়ণ, লুচ্চরূপী নারায়ণ! (মহিমাচরণের প্রতি)—কি বল গো? সকলই নারায়ণ।
মহিমাচরণ—আজ্ঞা, সবই নারায়ণ।
৪৬.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও গোপীপ্রেম
গিরিশ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—মহাশয়, একাঙ্গী প্রেম কাকে বলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—একাঙ্গী, কিনা, ভালবাসা একদিক থেকে। যেমন জল হাঁসকে চাচ্চে না, কিন্তু হাঁস জলকে ভালবাসে। আবার আছে সাধারণী, সমঞ্জসা, সমর্থা। সাধারণী প্রেম—নিজের সুখ চায়, তুমি সুখী হও আর না হও, যেমন চন্দ্রাবলীর ভাব। আবার সমঞ্জসা, আমারও সুখ হোক, তোমারও হোক। এ খুব ভাল অবস্থা।
“সকলের উচ্চ অবস্থা,—সমর্থা। যেমন শ্রীমতীর। কৃষ্ণসুখে সুখী, তুমি সুখে থাক, আমার যাই হোক।
“গোপীদের এই ভাব বড় উচ্চ ভাব।
“গোপীরা কে জান? রামচন্দ্র বনে বনে ভ্রমণ করতে করতে—ষষ্টি সহস্র ঋষি বসেছিলেন, তাদের দিকে একবার চেয়ে দেখেছিলেন, সস্নেহে! তাঁরা রামচন্দ্রকে দেখবার জন্য ব্যাকুল হয়েছিলেন। কোন কোন পুরাণে আছে, তারাই গোপী।”
একজন ভক্ত—মহাশয়! অন্তরঙ্গ কাহাকে বলে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—কিরকম জানো? যেমন নাটমন্দিরের ভিতরের থাম, বাইরের থাম। যারা সর্বদা কাছে থাকে, তারাই অন্তরঙ্গ।
[জ্ঞানযোগ ও ভক্তিযোগের সমন্বয়—ভরদ্বাজাদি ও রাম—পূর্বকথা—অরূপদর্শন—সাকার ত্যাগ—শ্রীশ্রীমা দক্ষিণেশ্বরে]
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমাচরণের প্রতি)—কিন্তু জ্ঞানী রূপও চায় না, অবতারও চায় না। রামচন্দ্র বনে যেতে যেতে কতকগুলি ঋষিদের দেখতে পেলেন। তাঁরা রামকে খুব আদর করে আশ্রমে বসালেন। সেই ঋষিরা বললেন, রাম তোমাকে আজ আমরা দেখলুম, আমাদের সকল সফল হল। কিন্তু আমরা তোমাকে জানি দশরথের বেটা। ভরদ্বাজাদি তোমাকে অবতার বলে; আমরা কিন্তু তা বলি না, আমরা সেই অখণ্ড সচ্চিদানন্দের চিন্তা করি। রাম প্রসন্ন হয়ে হাসতে লাগলেন।
“উঃ, আমার কি অবস্থা গেছে! মন অখণ্ডে লয় হয়ে যেত! এমন কতদিন! সব ভক্তি-ভক্ত ত্যাগ করলুম! জড় হলুম! দেখলুম, মাথাটা নিরাকার, প্রাণ যায় যায়! রামলালের খুড়ীকে ডাকব মনে করলুম!
“ঘরে ছবি-টবি যা ছিল, সব সরিয়ে ফেলতে বললুম। আবার হুঁশ যখন আসে, তখন মন নেমে আসবার সময় প্রাণ আটুপাটু করতে থাকে! শেষে ভাবতে লাগলুম, তবে কি নিয়ে থাকব! তখন ভক্তি-ভক্তের উপর মন এল।
“তখন লোকদের জিজ্ঞাসা করে বেড়াতে লাগলুম যে, এ আমার কি হল! ভোলানাথ1 বললে, ‘ভারতে2 আছে’। সমাধিস্থ লোক যখন সমাধি থেকে ফিরবে, তখন কি নিয়ে থাকবে? কাজেই ভক্তি-ভক্ত চাই। তা না হলে মন দাঁড়ায় কোথা?”
৪৬.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – সমাধিস্থ কি ফেরে? শ্রীমুখ-কথিত চরিতামৃত—কুয়ার সিং
মহিমাচরণ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—মহাশয়, সমাধিস্থ কি ফিরতে পারে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহিমার প্রতি একান্তে)—তোমায় একলা একলা বলব; তুমিই একথা শোনবার উপযুক্ত।
“কুয়ার সিং3 ওই কথা জিজ্ঞাসা করত। জীব আর ঈশ্বর অনেক তফাত। সাধন-ভজন করে সমাধি পর্যন্ত জীবের হতে পারে। ঈশ্বর যখন অবতীর্ণ হন, তিনি সমাধিস্থ হয়েও আবার ফিরতে পারেন। জীবের থাক—এরা যেন রাজার কর্মচারী। রাজার বারবাড়ি পর্যন্ত এদের গতায়াত। রাজার বাড়ি সাততলা, কিন্তু রাজার ছেলে সাততলায় আনাগোনা করতে পারে, আবার বাইরেও আসতে পারে। ফেরে না, ফেরে না, সব বলে। তবে শঙ্করাচার্য রামানুজ এরা সব কি? এরা ‘বিদ্যার আমি’ রেখেছিল।”
মহিমাচরণ—তাই তো; তা না হলে গ্রন্থ লিখলে কেমন করে?
শ্রীরামকৃষ্ণ—আবার দেখ, প্রহ্লাদ, নারদ, হনুমান, এরাও সমাধির পর ভক্তি রেখেছিল।
মহিমাচরণ—আজ্ঞা হাঁ।
[শুধু জ্ঞান বা জ্ঞানচর্চা—আর সমাধির পর জ্ঞান—বিদ্যার আমি]
শ্রীরামকৃষ্ণ—কেউ কেউ জ্ঞানচর্চা করে বলে মনে করে, আমি কি হইছি। হয়তো একটু বেদান্ত পড়েছে। কিন্তু ঠিক জ্ঞান হলে অহংকার হয় না, অর্থাৎ যদি সমাধি হয়, আর মানুষ তাঁর সঙ্গে এক হয়ে যায়, তাহলে আর অহংকার থাকে না। সমাধি না হলে ঠিক জ্ঞান হয় না। সমাধি হলে তাঁর সঙ্গে এক হওয়া যায়। আর অহং থাকে না।
“কিরকম জানো? ঠিক দুপুর বেলা সূর্য ঠিক মাথার উপর উঠে। তখন মানুষটা চারিদিকে চেয়ে দেখে, আর ছায়া নাই। তাই ঠিক জ্ঞান হলে—সমাধিস্থ হলে—অহংরূপ ছায়া থাকে না।
“ঠিক জ্ঞান হবার পর যদি অহং থাকে, তবে জেনো, ‘বিদ্যার আমি’ ‘ভক্তির আমি’ ‘দাস আমি’। সে ‘অবিদ্যার আমি’ নয়।
“আবার জ্ঞান ভক্তি দুইটিই পথ—যে পথ দিয়ে যাও, তাঁকেই পাবে। জ্ঞানী একভাবে তাঁকে দেখে, ভক্ত আর-একভাবে তাঁকে দেখে। জ্ঞানীর ঈশ্বর তেজোময়, ভক্তের রসময়।”
[শ্রীরামকৃষ্ণ ও মার্কণ্ডেয়চণ্ডীবর্ণিত অসুরবিনাশের অর্থ]
ভবনাথ কাছে বসিয়াছেন ও সমস্ত শুনিতেছেন। ভবনাথ নরেন্দ্রের ভারী অনুগত ও প্রথম প্রথম ব্রাহ্মসমাজে সর্বদা যাইতেন।
ভবনাথ (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি)—আমার একটা জিজ্ঞাসা আছে। আমি চণ্ডী বুঝতে পারছি না। চণ্ডীতে লেখা আছে যে, তিনি সব টক টক মারছেন। এর মানে কি?
শ্রীরামকৃষ্ণ—ও-সব লীলা। আমিও ভাবতুম ওই কথা। তারপর দেখলুম সবই মায়া। তাঁর সৃষ্টিও মায়া, তাঁর সংহারও মায়া।
ঘরের পশ্চিমদিকের ছাদে পাতা হইয়াছে। এইবার গিরিশ ঠাকুরকে ও ভক্তদিগকে আহ্বান করিয়া লইয়া গেলেন। বৈশাখ শুক্লা দশমী। জগৎ হাসিতেছে। ছাদ চন্দ্রকিরণে প্লাবিত। এ-দিকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে সম্মুখে রাখিয়া ভক্তেরা প্রসাদ পাইতে বসিয়াছেন। সকলেই আনন্দে পরিপূর্ণ।
ঠাকুর “নরেন্দ্র” “নরেন্দ্র” করিয়া পাগল। নরেন্দ্র সম্মুখের পঙ্ক্তিতে অন্যান্য ভক্তসঙ্গে বসিয়াছেন। মাঝে মাঝে ঠাকুর নরেন্দ্রের খবর লইতেছেন। অর্ধেক খাওয়া হইতে না হইতে ঠাকুর হঠাৎ নরেন্দ্রের কাছে নিজের পাত থেকে দই ও তরমুজের পানা লইয়া উপস্থিত। বলিলেন, “নরেন্দ্র তুই এইটুকু খা।” ঠাকুর বালকের ন্যায় আবার ভোজনের আসনে গিয়া উপবিষ্ট হইলেন।
*****