৩০.১ প্রথম পরিচ্ছেদ – রাখাল, নারাণ, নিত্যগোপাল ও ছোটগোপালের সংবাদ
আজ রবিবার, (শুক্লা দ্বিতীয়া) ৬ই আশ্বিন, ১২৯১, ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে অনেকগুলি ভক্ত সমবেত হইয়াছেন। রাম, মহেন্দ্র মুখুজ্জে, চুনিলাল, মাস্টার ইত্যাদি অনেকে আছেন।
চুনিলাল সবে শ্রীবৃন্দাবন হইতে ফিরিয়াছেন। সেখানে তিনি ও রাখাল বলরামের সঙ্গে গিয়াছিলেন। রাখাল ও বলরাম এখনও ফেরেন নাই। নিত্যগোপালও বৃন্দাবনে আছেন। ঠাকুর চুনিলালের সহিত বৃন্দাবনের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—রাখাল কেমন আছে?
চুনি—আজ্ঞে, তিনি এখন আছেন ভাল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—নিত্যগোপাল আসবে না?
চুনি—এখনও সেখানে আছেন, দেখে এসেছি।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তোমার পরিবারেরা কার সঙ্গে আসছে?
চুনি—বলরামবাবু বলেছেন, ভাল উপযুক্ত লোকের সঙ্গে পাঠিয়ে দেব। নাম দেন নাই।
ঠাকুর মহেন্দ্র মুখুজ্জের সঙ্গে নারাণের কথা কহিতে লাগিলেন। নারাণ স্কুলে পড়ে। ১৬।১৭ বত্সর বয়স। ঠাকুরের কাছে মাঝে মাঝে আসে। ঠাকুর বড় ভালবাসেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ—খুব সরল; না?
‘সরল’ এইকথা বলিতে বলিতে ঠাকুর যেন আনন্দে পরিপূর্ণ হইলেন।
মহেন্দ্র—আজ্ঞে হাঁ, খুব সরল।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তার মা সেদিন এসেছিল। অভিমানী দেখে ভয় হল। তারপর তোমরা এখানে আসো, কাপ্তেন আসে,—এ-সব সেদিন দেখতে পেলে। তখন অবশ্য ভাবলে যে, শুধু নারাণ আসে আর আমি আসি, তা নয়। (সকলের হাস্য) মিছরি এ-ঘরে ছিল তা দেখে বললে, বেশ মিছরি! তবেই জানলে, খাবার-দাবার কোন অসুবিধা নাই।
“তাদের সামনে বুঝি বাবুরামকে বললুম, নারাণের জন্য আর তোর জন্য এই সন্দেশগুলি রেখে দে। তারপর গণির মা ওরা সব বললে, মা গো, নৌকাভাড়ার জন্য যা করে! আমায় বললে যে আপনি নারাণকে বলুন যাতে বিয়ে করে। সে কথায় বললুম, ও-সব অদৃষ্টের কথা। ওতে কথা দেব কেন? (সকলের হাস্য)
“ভাল করে পড়াশুনা করে না; তাই বললে, আপনি বলুন, যাতে ভাল করে পড়ে। আমি বললুম, পড়িস রে। তখন আবার বলে, একটু ভাল করে বলুন। (সকলের হাস্য)
(চুনির প্রতি) “হ্যাঁ গা, গোপাল আসে না কেন?”
চুনি—রক্ত আমেশা হয়েছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—ওষুধ খাচ্ছে?
[থিয়েটার ও বেশ্যার অভিনয়—পূর্বকথা—বেলুনদর্শন ও শ্রীকৃষ্ণের উদ্দীপন]
ঠাকুর আজ কলিকাতায় স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা দেখিতে যাইবেন। স্টার থিয়েটারের তখন যেখানে অভিনয় হইত, আজকাল সেখানে কোহিনূর থিয়েটার। মহেন্দ্র মুখুজ্জের সঙ্গে তাঁহার গাড়ি করিয়া অভিনয় দেখিতে যাইবেন। কোন্খানে বসিলে ভাল দেখা যায়, সেই কথা হইতেছে। কেউ কেউ বললেন, একটাকার সিটে বসলে বেশ দেখা যায়। রাম বললেন, কেন, উনি বক্সে বসবেন।
ঠাকুর হাসিতেছেন। কেহ কেহ বলিলেন, বেশ্যারা অভিনয় করে। চৈতন্যদেব, নিতাই এ-সব অভিনয় তারা করে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদিগকে)—আমি তাদের মা আনন্দময়ী দেখব।
“তারা চৈতন্যদেব সেজেছে, তা হলেই বা। শোলার আতা দেখলে সত্যকার আতার উদ্দীপন হয়।
“একজন ভক্ত রাস্তায় যেতে যেতে দেখে, কতকগুলি বাবলাগাছ রয়েছে। দেখে ভক্তটি একেবারে ভাবাবিষ্ট। তার মনে হয়েছিল যে, ওই কাঠে শ্যামসুন্দরের বাগানের কোদালের বেশ বাঁট হয়! অমনি শ্যামসুন্দরকে মনে পড়েছে! যখন গড়ের মাঠে বেলুন দেখতে আমায় নিয়ে গিয়েছিল, তখন একটি সাহেবের ছেলে একটা গাছে ঠেসান দিয়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দেখাও যা, অমনি কৃষ্ণের উদ্দীপন হল; অমনি সমাধিস্থ হয়ে গেলাম!
“চৈতন্যদেব মেড়গাঁ দিয়ে যাচ্ছিলেন! শুনলেন, গাঁয়ের মাটিতে খোল তৈয়ার হয়! যাই শোনা অমনি ভাবাবিষ্ট হয়ে গেলেন।
“শ্রীমতী মেঘ কি ময়ূরের কণ্ঠ দেখলে আর স্থির থাকতে পারতেন না। শ্রীকৃষ্ণের উদ্দীপন হয়ে বাহ্যশূন্য হয়ে যেতেন।”
ঠাকুর একটু চুপ করিয়া বসিয়া আছেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে আবার কথা কহিতেছেন—“শ্রীমতীর মহাভাব। গোপীপ্রেমে কোন কামনা নাই। ঠিক ভক্ত যে, সে কোন কামনা করে না। কেবল শুদ্ধাভক্তি প্রার্থনা করে; কোন শক্তি কি সিদ্ধাই কিছু চায় না।”
৩০.২ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – ন্যাংটাবাবার শিক্ষা—ঈশ্বরলাভের বিঘ্ন অষ্টসিদ্ধি
শ্রীরামকৃষ্ণ—সিদ্ধাই থাকা এক মহাগোল। ন্যাংটা আমায় শিখালে—একজন সিদ্ধ সমুদ্রের ধারে বসে আছে, এমন সময় একটা ঝড় এল। ঝড়ে তার কষ্ট হল বলে সে বললে, ঝড় থেমে যাক। তার বাক্য মিথ্যা হবার নয়। একখানা জাহাজ পালভরে যাচ্ছিল। ঝড় হঠাৎ থামাও যা আর জাহাজ টুপ করে ডুবে গেল। এক জাহাজ লোক সেই সঙ্গে ডুবে গেলো। এখন এতগুলি লোক যাওয়াতে যে পাপ হল, সব ওর হলো। সেই পাপে সিদ্ধাইও গেল, আবার নরকও হলো।
“একটি সাধুর খুব সিদ্ধাই হয়েছিল, আর সেই জন্য অহংকারও হয়েছিল। কিন্তু সাধুটি লোক ভাল ছিল, আর তার তপস্যাও ছিল। ভগবান ছদ্মবেশে সাধুর বেশ ধরে একদিন তার কাছে এলেন। এসে বললেন, ‘মহারাজ! শুনেছি আপনার খুব সিদ্ধাই হয়েছে’। সাধু খাতির করে তাঁকে বসালেন। এমন সময় একটা হাতি সেখান দিয়ে যাচ্ছে। তখন নূতন সাধুটি বললেন, ‘আচ্ছা মহারাজ, আপনি মনে করলে এই হাতিটাকে মেরে ফেলতে পারেন?’ সাধু বললেন, ‘য়্যাসা হোনে শক্তা’। এই বলে ধুলো পড়ে হাতিটার গায়ে দেওয়াতে সে ছটফট করে মরে গেল। তখন যে সাধুটি এসেছে, সে বললে, ‘আপনার কি শক্তি! হাতিটাকে মেরে ফেললেন।’ সে হাসতে লাগল। তখন ও সাধুটি বললে, ‘আচ্ছা, হাতিটাকে আবার বাঁচাতে পারেন?’ সে বললে, ‘ওভি হোনে শক্তা হ্যায়।’ এই বলে আবার যাই ধুলো পড়ে দিলে, অমনি হাতিটা ধড়মড় করে উঠে পড়ল। তখন এ-সাধুটি বললে, ‘আপনার কি শক্তি! কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি। এই যে হাতি মারলেন, আর হাতি বাঁচালেন, আপনার কি হল? নিজের কি উন্নতি হল? এতে কি আপনি ভগবানকে পেলেন?’ এই বলিয়া সাধুটি অন্তর্ধান হলেন।
“ধর্মের সূক্ষ্মা গতি। একটু কামনা থাকলে ভগবানকে পাওয়া যায় না। ছুঁচের ভিতর সুতো যাওয়া, একটু রোঁ থাকলে হয় না।
“কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ভাই আমাকে যদি লাভ করতে চাও, তাহলে অষ্টসিদ্ধির একটা সিদ্ধি থাকলে হবে না।
“কি জান? সিদ্ধাই থাকলে অহংকার হয়, ঈশ্বরকে ভুলে যায়।
“একজন বাবু এসেছিল—ট্যারা। বলে, আপনি পরমহংস, তা বেশ, একটু স্বস্ত্যয়ন করতে হবে। কি হীনবুদ্ধি। ‘পরমহংস’; আবার স্বস্ত্যয়ন করতে হবে। স্বস্ত্যয়ন করে ভাল করা,—সিদ্ধাই। অহংকারে ঈশ্বরলাভ হয় না। অহংকার কিরূপ জান? যেন উঁচু ঢিপি, বৃষ্টির জল জমে না, গড়িয়ে যায়। নিচু জমিতে জল জমে আর অঙ্কুর হয়; তারপর গাছ হয়; তারপর ফল হয়।”
[Love to all—ভালবাসায় অহংকার যায়—তবে ঈশ্বরলাভ]
“হাজরাকে তাই বলি, আমি বুঝেছি, আর সব বোকা—এ-বুদ্ধি করো না। সকলকে ভালবাসতে হয়। কেউ পর নয়। সর্বভূতেই সেই হরিই আছেন। তিনি ছাড়া কিছুই নাই। প্রহ্লাদকে ঠাকুর বললেন, তুমি বর নাও। প্রহ্লাদ বললেন, আপনার দর্শন পেয়েছি, আমার আর কিছু দরকার নাই। ঠাকুর ছাড়লেন না। তখন প্রহ্লাদ বললেন, যদি বর দেবে, তবে এই বর দেও, আমায় যারা কষ্ট দিয়েছে তাদের অপরাধ না হয়।
“এর মানে এই যে, হরি একরূপে কষ্ট দিলেন। সেই লোকদের কষ্ট দিলে হরির কষ্ট হয়।”
৩০.৩ তৃতীয় পরিচ্ছেদ – শ্রীরামকৃষ্ণের জ্ঞানোন্মাদ ও জাতি বিচার
[পূর্বকথা ১৮৫৭—কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার পর জ্ঞানীপাগলদর্শন—হলধারী]
শ্রীরামকৃষ্ণ—শ্রীমতীর প্রেমোন্মাদ। আবার ভক্তি-উন্মাদ আছে। যেমন হনুমানের। সীতা আগুনে প্রবেশ করেছে দেখে রামকে মারতে যায়। আবার আছে জ্ঞানোন্মাদ। একজন জ্ঞানী পাগলের মতো দেখেছিলাম। কালীবাড়ির সবে প্রতিষ্ঠার পর। লোকে বললে, রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মসভার একজন। একপায়ে ছেঁড়া জুতা, হাতে কঞ্চি আর একটি ভাঁড়, আঁবচারা। গঙ্গায় ডুব দিলে। তারপর কালীঘরে গেল। হলধারী তখন কালীঘরে বসে আছে। তারপর মত্ত হয়ে স্তব করতে লাগল—
ক্ষ্রৌং ক্ষ্রৌং খট্টাঙ্গধারিণীম্ ইত্যাদি
“কুকুরের কাছে গিয়ে কান ধরে তার উচ্ছিষ্ট খেলে—কুকুর কিছু বলে নাই। আমারও তখন এই অবস্থা আরম্ভ হয়েছে। আমি হৃদের গলা ধরে বললাম, ওরে হৃদে, আমারও কি ওই দশা হবে?
“আমার উন্মাদ অবস্থা! নারায়ণ শাস্ত্রী এসে দেখলে, একটা বাঁশ ঘাড়ে করে বেড়াচ্ছি। তখন সে লোকদের কাছে বললে ওহ্, উন্মস্ত্ হ্যায়। সে অবস্থায় জাত বিচার কিছু থাকতো না। একজন নীচ জাতি, তার মাগ শাক রেঁধে পাঠাতো, আমি খেতুম।
“কালীবাড়িতে কাঙালীরা খেয়ে গেল, তাদের পাতা মাথায় আর মুখে ঠেকালুম। হলধারী তখন আমায় বললে, তুই করছিস কি? কাঙালীদের এঁটো খেলি, তোর ছেলেপিলের বিয়ে হবে কেমন করে? আমার তখন রাগ হল। হলধারী আমার দাদা হয়। তাহলে কি হয়? তাকে বললাম, তবে রে শ্যালা, তুমি না গীতা, বেদান্ত পড়? তুমি না শিখাও ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা? আমার আবার ছেলেপুলে হবে তুমি ঠাউরেছ! তোর গীতাপাঠের মুখে আগুন!
(মাস্টারের প্রতি)—“দেখ, শুধু পড়াশুনাতে কিছু হয় না। বাজনার বোল লোকে মুখস্থ বেশ বলতে পারে, হাতে আনা বড় শক্ত!”
ঠাকুর আবার নিজের জ্ঞানোন্মাদ অবস্থা বর্ণনা করিতেছেন।
[পূর্বকথা—মথুর সঙ্গে নবদ্বীপ—ঠাকুর চিনে শ্যাঁকারীর পায়ে ধরেন]
“সেজোবাবুর সঙ্গে কদিন বজরা করে হাওয়া খেতে গেলাম। সেই যাত্রায় নবদ্বীপেও যাওয়া হয়েছিল। বজরাতে দেখলাম মাঝিরা রাঁধছে। তাদের কাছে দাঁড়িয়ে আছি, সেজোবাবু বললে, বাবা ওখানে কি করছ? আমি হেসে বললাম, মাঝিরা বেশ রাঁধছে। সেজোবাবু বুঝেছে যে, ইনি এবারে চেয়ে খেতে পারেন! তাই বললে বাবা সরে এসো, সরে এসো!
“এখন কিন্তু আর পারি না। সে অবস্থা এখন নাই। এখন ব্রাহ্মণ হবে, আচারী হবে, ঠাকুরের ভোগ হবে, তবে ভাত খাব।
“কি অবস্থা সব গেছে! দেশে চিনে শ্যাঁকারী আর আর সমবয়সীদের বললাম, ওরে তোদের পায়ে পড়ি একবার হরিবোল বল! সকলের পায়ে পড়তে যাই! তখন চিনে বললে, ওরে তোর এখন প্রথম অনুরাগ তাই সব সমান বোধ হয়েছে। প্রথম ঝড় উঠলে যখন ধুলা উড়ে তখন আমগাছ তেঁতুলগাছ সব এক বোধ হয়। এটা আমগাছ এটা তেঁতুলগাছ চেনা যায় না।”
[শ্রীরামকৃষ্ণের মত কি, সংসার না সর্বত্যাগ? কেশব সেনের সন্দেহ]
একজন ভক্ত—এই ভক্তি উন্মাদ, কি প্রেম উন্মাদ, কি জ্ঞান উন্মাদ, সংসারী লোকের হলে কেমন করে চলবে?
শ্রীরামকৃষ্ণ (সংসারীভক্ত দৃষ্টে)—যোগী দুরকম। ব্যক্ত যোগী আর গুপ্ত যোগী। সংসারে গুপ্ত যোগী। কেউ তাকে টের পায় না। সংসারীর পক্ষে মনে ত্যাগ, বাহিরে ত্যাগ নয়।
রাম—আপনার ছেলে ভুলানো কথা। সংসারে জ্ঞানী হতে পারে, বিজ্ঞানী হতে পারে না।
শ্রীরামকৃষ্ণ—শেষে বিজ্ঞানী হয় হবে। জোর করে সংসারত্যাগ ভাল নয়।
রাম—কেশব সেন বলতেন, ওঁর কাছে লোকে অত যায় কেন? একদিন কুটুস করে কামড়াবেন, তখন পালিয়ে আসতে হবে।
শ্রীরামকৃষ্ণ—কুটুস করে কেন কামড়াব? আমি তো লোকদের বলি, এও কর, ওও কর; সংসারও কর; ঈশ্বরকেও ডাক। সব ত্যাগ করতে বলি না। (সহাস্যে) কেশব সেন একদিন লেকচার দিলে; বললে, ‘হে ঈশ্বর, এই কর, যেন আমরা ভক্তিনদীতে ডুব দিতে পারি, আর ডুব দিয়ে যেন সচ্চিদানন্দ-সাগরে গিয়ে পড়ি’। মেয়েরা সব চিকের ভিতরে ছিল। আমি কেশবকে বললাম, একেবারে সবাই ডুব দিলে কি হবে! তাহলে এদের (মেয়েদের) দশা কি হবে? এক-একবার আড়ায় উঠো; আবার ডুব দিও, আবার উঠো! কেশব আর সকলে হাসতে লাগল। হাজরা বলে, তুমি রজোগুণী লোক বড় ভালবাস। যাদের টাকা-কড়ি মান-সম্ভ্রম, খুব আছে। তা যদি হল তবে হরিশ, নোটো ওদের ভালবাসি কেন? নরেন্দ্রকে কেন ভালবাসি? তার তো কলাপোড়া খাবার নুন নাই!
শ্রীরামকৃষ্ণ ঘরের বাহিরে আসিলেন ও মাস্টারের সহিত কথা কহিতে কহিতে ঝাউতলার দিকে যাইতেছেন। একটি ভক্ত গাড়ু ও গামছা লইয়া সঙ্গে সঙ্গে যাইতেছেন। কলিকাতায় আজ চৈতন্যলীলা দেখিতে যাইবেন সেই কথা হইতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি, পঞ্চবটীর নিকট)—রাম সব রজোগুণের কথা বলছে। এত বেশি দাম দিয়ে বসবার কি দরকার।
বক্সের টিকিট লইবার দরকার নাই ঠাকুর বলিতেছেন।
৩০.৪ চতুর্থ পরিচ্ছেদ – হাতিবাগানে ভক্তমন্দিরে—শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখুজ্জের সেবা
শ্রীরামকৃষ্ণ শ্রীযুক্ত মহেন্দ্র মুখুজ্জের গাড়ি করিয়া দক্ষিণেশ্বর হইতে কলিকাতায় আসিতেছেন। রবিবার, ৬ই আশ্বিন, ২১শে সেপ্টেম্বর, ১৮৮৪; আশ্বিন শুক্লা দ্বিতীয়া। বেলা ৫টা। গাড়ির মধ্যে মহেন্দ্র মুখুজ্জে, মাস্টার ও আরও দু-একজন আছেন। একটু যাইতে যাইতে ঈশ্বরচিন্তা করিতে করিতে ঠাকুর ভাবসমাধিতে মগ্ন হইলেন।
অনেকক্ষণ পরে সমাধিভঙ্গ হইল। ঠাকুর বলিতেছেন, “হাজরা আবার আমায় শেখায়! শ্যালা!” কিয়ত্ক্ষণ পরে বলিতেছেন, “আমি জল খাব।” বাহ্য জগতে মন নামাইবার জন্য ঠাকুর ওই কথা প্রায়ই সমাধির পর বলিতেন।
মহেন্দ্র মুখুজ্জে (মাস্টারের প্রতি)—তাহলে কিছু খাবার আনলে হয় না?
মাস্টার—ইনি এখন খাবেন না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভাবস্থ)—আমি খাব;—বাহ্যে যাব।
মহেন্দ্র মুখুজ্জের হাতিবাগানে ময়দার কল আছে। সেই কলেতে ঠাকুরকে লইয়া যাইতেছেন। সেখানে একটু বিশ্রাম করিয়া স্টার থিয়েটারে চৈতন্যলীলা দেখিতে যাইবেন। মহেন্দ্রের বাড়ি বাগবাজার ৺মদনমোহনজীর মন্দিরের কিছু উত্তরে। পরমহংসদেবকে তাঁহার পিতাঠাকুর জানেন না। তাই মহেন্দ্র ঠাকুরকে বাড়িতে লইয়া যান নাই। তাঁহার দ্বিতীয় ভ্রাতা প্রিয়নাথও একজন ভক্ত।
মহেন্দ্রের কলে তক্তপোশের উপর সতরঞ্চি পাতা। তাহারই উপরে ঠাকুর বসিয়া আছেন ও ঈশ্বরের কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টার ও মহেন্দ্রের প্রতি)—শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত শুনতে শুনতে হাজরা বলে, এ-সব শক্তির লীলা—বিভু এর ভিতর নাই। বিভু ছাড়া শক্তি কখন হয়? এখানকার মত উলটে দেবার চেষ্টা!
[ব্রহ্ম বিভুরূপে সর্বভূতে—শুদ্ধভক্ত ষড়ৈশ্বর্য চায় না]
“আমি জানি, ব্রহ্ম আর শক্তি অভেদ। যেমন জল আর জলের হিমশক্তি। অগ্নি আর দাহিকা শক্তি। তিনি বিভুরূপে সর্বভূতে আছেন; তবে কোনওখানে বেশি শক্তির, কোনখানে কম শক্তির প্রকাশ। হাজরা আবার বলে, ভগবানকে পেলে তাঁর মতো ষড়ৈশ্বর্যশালী হয়, ষড়ৈশ্বর্য থাকবে ব্যবহার করুক আর না করুক।
মাস্টার—ষড়ৈশ্বর্য হাতে থাকা চাই। (সকলের হাস্য)
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে)—হাঁ, হাতে থাকা চাই! কি হীনবুদ্ধি! যে ঐশ্বর্য কখন ভোগ করে নাই, সেই ঐশ্বর্য ঐশ্বর্য করে অধৈর্য হয়। যে শুদ্ধভক্ত সে কখনও ঐশ্বর্য প্রার্থনা করে না।
কলবাড়িতে পান সাজা ছিল না। ঠাকুর বলিতেছেন, পানটা আনিয়ে লও। ঠাকুর বাহ্যে যাইবেন। মহেন্দ্র গাড়ু করিয়া জল আনাইলেন ও নিজে গাড়ু হাতে করিলেন। ঠাকুরকে সঙ্গে করিয়া মাঠের দিকে লইয়া যাইবেন। ঠাকুর মণিকে সম্মুখে দেখিয়া মহেন্দ্রকে বলিলেন, “তোমার নিতে হবে না—এঁকে দাও?” মণি গাড়ু লইয়া ঠাকুরের সঙ্গে কলবাড়ির ভিতরের মাঠের দিকে গেলেন। মুখ ধোয়ার পর ঠাকুরকে তামাক সেজে দেওয়া হইল। ঠাকুর মাস্টারকে বলিতেছেন, সন্ধ্যা কি হয়েছে? তাহলে আর
তামাকটা খাই না; “সন্ধ্যা হলে সর্ব কর্ম ছেড়ে হরি স্মরণ করবে।”এই বলিয়া ঠাকুর হাতের লোম দেখিতেছেন—গনা যায় কি না। লোম যদি গনা না যায়, তাহা হইলে—সন্ধ্যা হইয়াছে।
৩০.৫ পঞ্চম পরিচ্ছেদ – নাট্যালয়ে চৈতন্যলীলা—শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ
[মাস্টার, বাবুরাম, নিত্যানন্দবংশের ভক্ত, মহেন্দ্র মুখুজ্জে, গিরিশ]
ঠাকুরের গাড়ি বিডন স্ট্রীটে স্টার থিয়েটারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত। রাত প্রায় সাড়ে আটটা। সঙ্গে মাস্টার, বাবুরাম, মহেন্দ্র মুখুজ্জে ও আরও দু-একটি ভক্ত। টিকিট কিনিবার বন্দোবস্ত হইতেছে। নাট্যালয়ের ম্যানেজার শ্রীযুক্ত গিরিশ ঘোষ কয়েকজন কর্মচারী সঙ্গে ঠাকুরের গাড়ির কাছে আসিয়াছেন, অভিবাদন করিয়া তাঁহাকে সাদরে উপরে লইয়া গেলেন। গিরিশ পরমহংসদেবের নাম শুনিয়াছেন। তিনি চৈতন্যলীলা অভিনয় দর্শন করিতে আসিয়াছেন, শুনিয়া পরম আহ্লাদিত হইয়াছেন। ঠাকুরকে দক্ষিণ-পশ্চিমের বক্সে বসানো হইল। ঠাকুরের পার্শ্বে মাস্টার বসিলেন। পশ্চাতে বাবুরাম, আরও দু-একটি ভক্ত।
নাট্যালয় আলোকাকীর্ণ। নিচে অনেক লোক। ঠাকুরের বামদিকে ড্রপসিন দেখা যাইতেছে। অনেকগুলি বক্সে লোক হইয়াছে। এক-একজন বেহারা নিযুক্ত, বক্সের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া হাওয়া করিতেছে। ঠাকুরকে হাওয়া করিতে গিরিশ বেহারা নিযুক্ত করিয়া গেলেন।
ঠাকুর নাট্যালয় দেখিয়া বালকের ন্যায় আনন্দিত হইয়াছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি, সহাস্যে)—বাঃ, এখান বেশ! এসে বেশ হল। অনেক লোক একসঙ্গে হলে উদ্দীপন হয়। তখন ঠিক দেখতে পাই, তিনিই সব হয়েছেন।
মাস্টার—আজ্ঞা, হাঁ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—এখানে কত নেবে?
মাস্টার—আজ্ঞা, কিছু নেবে না। আপনি এসেছেন ওদের খুব আহ্লাদ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—সব মার মাহাত্ম্য!
ড্রপসিন উঠিয়া গেল। এককালে দর্শকবৃন্দের দৃষ্টি রঙ্গমঞ্চের উপর পড়িল। প্রথমে, পাপ আর ছয় রিপুর সভা। তারপর বনপথে বিবেক, বৈরাগ্য ও ভক্তির কথাবার্তা।
ভক্তি বলিতেছেন, গৌরাঙ্গ নদীয়ায় জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। তাই বিদ্যাধরীগণ আর মুনিঋষিগণ ছদ্মবেশে দর্শন করিতে আসিতেছেন।
ধন্য ধরা নদীয়ায় এলো গোরা।
দেখ, দেখ না বিমানে বিদ্যাধরীগণে, আসিতেছে হরি দরশনে।
দেখ, প্রেমানন্দে হইয়া বিভোল, মুনি ঋষি আসিছে সকল।
বিদ্যাধরীগণ আর মুনিঋষিরা গৌরাঙ্গকে ভগবানের অবতারজ্ঞানে স্তব করিতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহাদের দেখিয়া ভাবে বিভোর হইতেছেন। মাস্টারকে বলিতেছেন, আহা! কেমন দেখো!
বিদ্যাধরীগণ ও মুনিঋষিগণ গান করিয়া স্তব করিতেছেন :
পুরুষগণ—কেশব কুরু করুণা দীনে, কুঞ্জকাননচারী।
স্ত্রীগণ—মাধব মনোমোহন মোহন মুরলীধারী।
সকলে—হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, মন আমার।
পুরুষগণ—ব্রজকিশোর কালীয়হর কাতর-ভয়-ভঞ্জন।
স্ত্রীগণ—নয়ন বাঁকা, বাঁকা শিখিপাখা, রাধিকা হৃদিরঞ্জন।
পুরুষগণ—গোবর্ধনধারণ, বনকুসুমভূষণ, দামোদর কংসদর্পহারী।
স্ত্রীগণ—শ্যাম রাসরসবিহারী।
সকলে—হরিবোল, হরিবোল, হরিবোল, মন আমার।
বিদ্যাধরীগণ যখন গাইলেন—
‘নয়ন বাঁকা, বাঁকা শিখিপাখা, রাধিকা-হৃদিরঞ্জন’
তখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর-সমাধি-মধ্যে মগ্ন হইলেন। কনসার্ট (ঐকতানবাদ্য) হইতেছে। ঠাকুরের কোন হুঁশ নাই।
৩০.৬ ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – চৈতন্যলীলাদর্শন—গৌরপ্রেমে মাতোয়ারা শ্রীরামকৃষ্ণ
জগন্নাথ মিশ্রের ঘরে অতিথি আসিয়াছেন। বালক নিমাই সদানন্দে সমবয়স্যদের সহিত গান গাহিয়া বেড়াইতেছেন :
কাঁহা মেরা বৃন্দাবন, কাঁহা যশোদা মাই ।
কাঁহা মেরা নন্দ পিতা, কাঁহা বলাই ভাই ॥
কাঁহা মেরি ধবলী শ্যামলী, কাঁহা মেরি মোহন মুরলী ।
শ্রীদাম সুদাম রাখালগণ কাঁহা মে পাই ॥
কাঁহা মেরি যমুনাতট, কাঁহা মেরি বংশীবট ।
কাঁহা গোপনারী মেরি, কাঁহা হামারা রাই ॥
অতিথি চক্ষু বুজিয়া, ভগবানকে অন্ন নিবেদন করিতেছেন। নিমাই দৌড়িয়া গিয়া সেই অন্ন ভক্ষণ করিতেছেন। অতিথি ভগবান বলিয়া তাঁহাকে জানিতে পারিলেন ও দশাবতারের স্তব করিয়া প্রসন্ন করিতেছেন। মিশ্র ও শচীর কাছে বিদায় লইবার সময় তিনি আরার গান করিয়া স্তব করিতেছেন—
জয় নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র জয় ভবতারণ ।
অনাথত্রাণ জীবপ্রাণ ভীতভয়বারণ ॥
যুগে যুগে রঙ্গ, নব লীলা নব রঙ্গ,
নব তরঙ্গ নব প্রসঙ্গ ধরাভার ধারণ ।
তাপহারী প্রেমবারি, বিতর রাসরসবিহারী,
দীনআশ-কলুষনাশ দুষ্ট-ত্রাসকারণ ।
স্তব শুনিতে শুনিতে ঠাকুর আবার ভাবে বিভোর হইতেছেন।
নবদ্বীপের গঙ্গাতীর—গঙ্গাস্নানের পর ব্রাহ্মণেরা, মেয়ে পুরুষ ঘাটে বসিয়া পূজা করিতেছেন। নিমাই নৈবেদ্য কাড়িয়া খাইতেছেন। একজন ব্রাহ্মণ ভারী রেগে গেলেন, আর বললেন, আরে বেল্লিক! বিষ্ণুপূজার নৈবিদ্যি কেড়ে নিচ্ছিস—সর্বনাশ হবে তোর! নিমাই তবুও কেড়ে নিলেন, আর পলায়ন করিতে উদ্যত হইলেন। অনেক মেয়েরা ছেলেটিকে বড় ভালবাসে। নিমাই চলে যাচ্ছে দেখে তাদের প্রাণে সইল না। তারা উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিল, নিমাই, ফিরে আয়; নিমাই ফিরে আয়। নিমাই শুনিলেন না।
একজন নিমাইকে ফিরাইবার মহামন্ত্র জানিতেন। তিনি “হরিবোল হরিবোল” বলিতে লাগিলেন। অমনি নিমাই ‘হরিবোল’ ‘হরিবোল’ বলিতে বলিতে ফিরিলেন।
মণি ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছেন। বলিতেছেন, আহা!
ঠাকুর আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। ‘আহা’ বলিতে বলিতে মণির দিকে তাকাইয়া প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (বাবুরাম ও মাস্টারকে)—দেখ, যদি আমার ভাব কি সমাধি হয়, তোমরা গোলমাল করো না। ঐহিকেরা ঢঙ মনে করবে।
নিমাই-এর উপনয়ন। নিমাই সন্ন্যাসী সাজিয়াছেন। শচী ও প্রতিবাসিনিগণ চতুর্দিকে দাঁড়াইয়া। নিমাই গান গাইয়া ভিক্ষা করিতেছেন ঃ
দে গো ভিক্ষা দে ।
আমি নূতন যোগী ফিরি কেঁদে কেঁদে ।
ওগো ব্রজবাসী তোদের ভালবাসি,
ওগো তাইতো আসি, দেখ মা উপবাসী ।
দেখ মা দ্বারে যোগী বলে ‘রাধে রাধে’ ।
বেলা গেল যেতে হবে ফিরে,
একাকী থাকি মা যমুনাতীরে
আঁখিনীরে মিশে নীরে,
চলে ধীরে ধীরে ধারা মৃদু নাদে ।
সকলে চলিয়া গেলেন। নিমাই একাকী আছেন। দেবগণ ব্রাহ্মণ-ব্রাহ্মণী বেশে তাঁহাকে স্তব করিতেছেন।
পুরুষগণ—চন্দ্রকিরণ অঙ্গে, নমো বামনরূপধারী।
স্ত্রীগণ—গোপীগণ মনোমোহন, মঞ্জুকুঞ্জচারী।
নিমাই—জয় রাধে শ্রীরাধে।
পুরুষগণ—ব্রজবালক সঙ্গ, মদন মান ভঙ্গ।
স্ত্রীগণ—উন্মাদিনী ব্রজকামিনী, উন্মাদ তরঙ্গ।
পুরুষগণ—দৈত্যছলন, নারায়ণ, সুরগণভয়হারী।
স্ত্রীগণ—ব্রজবিহারী গোপনারী-মান-ভিখারী।
নিমাই—জয় রাধে শ্রীরাধে।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এই গান শুনিতে শুনিতে সমাধিস্থ হইলেন। যবনিকা পতন হইল। কনসার্ট বাজিতেছে।
[“সংসারী লোক দুদিক রাখতে বলে”—গঙ্গাদাস ও শ্রীবাস]
অদ্বৈতের বাটীর সম্মুখে শ্রীবাসাদি কথা কহিতেছেন। মুকুন্দ মধুর কণ্ঠে গান গাইতেছেন :
আর ঘুমাইও না মন। মায়াঘোরে কতদিন রবে অচেতন ।
কে তুমি কি হেতু এলে, আপনারে ভুলে গেলে
চাহরে নয়ন মেলে ত্যজ কুস্বপন ॥
রয়েছো অনিত্য ধ্যানে নিত্যানন্দে হের প্রাণে,
তম পরিহরি হের তরুণ তপন ॥
মুকুন্দ বড় সুকণ্ঠ। শ্রীরামকৃষ্ণ মণির নিকট প্রশংসা করিতেছেন।
নিমাই বাটীতে আছেন। শ্রীবাস দেখা করিতে আসিয়াছেন। আগে শচীর সঙ্গে দেখা হইল। শচী কাঁদিতে লাগিলেন। বলিলেন, পুত্র আমার গৃহধর্মে মন দেয় না।
‘যে অবধি গেছে বিশ্বরূপ,
প্রাণ মম কাঁপে নিরন্তর, পাছে হয় নিমাই সন্ন্যাসী।’
এমন সময় নিমাই আসিতেছেন। শচী শ্রীবাসকে বলিতেছেন—
‘আহা দেখ দেখ পাগলের প্রায়,
আঁখিনীরে বুক ভেসে যায়, বল বল এ ভাব কেমনে যাবে?’
নিমাই শ্রীবাসকে দেখিয়া তাঁহার পায়ে জড়াইয়া কাঁদিতেছেন—আর বলিতেছেন—
কই প্রভু কই মম কৃষ্ণভক্তি হলো,
অধম জনম বৃথা কেটে গেল ।
বল প্রভু, কৃষ্ণ কই, কৃষ্ণ কোথা পাব,
দেহ পদধূলি বনমালী যেন পাই ।
শ্রীরামকৃষ্ণ মাস্টারের দিকে তাকাইয়া কথা কহিতে যাইতেছেন, কিন্তু পারিতেছেন না। গদগদ স্বর! গণ্ডদেশ নয়নজলে ভাসিয়া গেল। একদৃষ্টে দেখিতেছেন, নিমাই শ্রীবাসের পা জড়াইয়া রহিয়াছেন। আর বলিতেছেন, ‘কই প্রভু কৃষ্ণভক্তি তো হল না।’
এদিকে নিমাই পড়ুয়াদের আর পড়াইতে পারিতেছেন না। গঙ্গাদাসের কাছে নিমাই পড়িয়াছিলেন। তিনি নিমাইকে বুঝাইতে আসিয়াছেন। শ্রীবাসকে বলিলেন—শ্রীবাস ঠাকুর, আমরাও ব্রাহ্মণ, বিষ্ণুপূজা করে থাকি, আপনারা মিলে দেখছি সংসারটা ছারখার করলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে)—এ সংসারীর শিক্ষা—এও কর, ওও কর। সংসারী যখন শিক্ষা দেয়, তখন দুদিক রাখতে বলে।
মাস্টার—আজ্ঞা, হাঁ।
গঙ্গাদাস নিমাইকে আবার বুঝাইতেছেন—‘ওহে নিমাই, তোমার তো শাস্ত্রজ্ঞান হয়েছে? তুমি আমার সঙ্গে তর্ক কর। সংসারধর্ম অপেক্ষা কোন্ ধর্ম প্রধান, আমায় বোঝাও। তুমি গৃহী, গৃহীর মতো আচার না করে অন্য আচার কেন কর?’
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে)—দেখলে? দুইদিক রাখতে বলছে!
মাস্টার—আজ্ঞা, হাঁ।
নিমাই বলিলেন, আমি ইচ্ছা করে সংসারধর্ম উপেক্ষা করি নাই; আমার বরং ইচ্ছা যাতে সব বজায় থাকে। কিন্তু—
প্রভু কোন্ হেতু কিছু নাহি জানি,
প্রাণ টানে কি করি কি করি,
ভাবি কুলে রই, কুলে আর রহিতে না পারি,
প্রাণ ধায় বুঝালে না ফেরে,
সদা চায় ঝাঁপ দিতে অকুল পাথারে ।
শ্রীরামকৃষ্ণ—আহা!
৩০.৭ সপ্তম পরিচ্ছেদ – নাট্যালয়ে নিত্যানন্দবংশ ও শ্রীরামকৃষ্ণের উদ্দীপন
[মাস্টার, বাবুরাম, খড়দার নিত্যানন্দবংশের গোস্বামী]
নবদ্বীপে নিত্যানন্দ আসিয়াছেন, তিনি নিমাইকে খুঁজিতেছেন এমন সময় নিমাই-এর সহিত দেখা হইল। নিমাইও তাঁহাকে খুঁজিতেছিলেন। মিলনের পর নিমাই বলিতেছেন—
সার্থক জীবন; সত্য মম ফলেছে স্বপন;
লুকাইলে স্বপ্নে দেখা দিয়ে ।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারকে গদ্গদ স্বরে)—নিমাই বলছে, স্বপ্নে দেখেছি!
শ্রীবাস ষড়্ভুজ দর্শন করছেন, আর স্তব করছেন।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবাবিষ্ট হইয়া ষড়্ভুজ দর্শন করিতেছেন।
গৌরাঙ্গের ঈশ্বর আবেশ হইয়াছে। তিনি অদ্বৈত, শ্রীবাস, হরিদাস ইত্যাদির সহিত ভাবে কথা কহিতেছেন।
গৌরাঙ্গের ভাব বুঝিতে পারিয়া নিতাই গান গাইতেছেন :
কই কৃষ্ণ এল কুঞ্জে প্রাণ সই!
দে রে কৃষ্ণ দে, কৃষ্ণ এনে দে, রাধা জানে কি গো কৃষ্ণ বই ।
শ্রীরামকৃষ্ণ গান শুনিতে শুনিতে সমাধিস্থ হইলেন। অনেকক্ষণ ওইভাবে রহিলেন। কনসার্ট চলিতে লাগিল। ঠাকুরের সমাধি ভঙ্গ হইল। ইতিমধ্যে খড়দার নিত্যানন্দ গোস্বামীর বংশের একটি বাবু আসিয়াছেন ও ঠাকুরের চেয়ারের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া আছেন। বয়স ৩৪/৩৫ হইবে। ঠাকুর তাঁহাকে দেখিয়া আনন্দে ভাসিতে লাগিলেন। তাঁহার হাত ধরিয়া কত কথা কহিতেছেন। মাঝে মাঝে তাঁহাকে বলিতেছেন, “এখানে বসো না; তুমি এখানে থাকলে খুব উদ্দীপন হয়।” সস্নেহে তাহার হাত ধরিয়া যেন খেলা করিতেছেন। সস্নেহে মুখে হাত দিয়া আদর করিতেছেন।
গোস্বামী চলিয়া গেলে মাস্টারকে বলিতেছেন, “ও বড় পণ্ডিত, বাপ বড় ভক্ত। আমি খড়দার শ্যামসুন্দর দেখতে গেলে, যে ভোগ একশ টাকা দিলে পাওয়া যায় না সেই ভোগ এনে আমায় খাওয়ায়।
“এর লক্ষণ বড় ভাল; একটু নেড়েচেড়ে দিলে চৈতন্য হয়। ওকে দেখতে দেখতে বড় উদ্দীপন হয়। আর একটু হলে আমি দাঁড়িয়ে পড়তুম।”
গোস্বামীকে দেখিতে দেখিতে আর একটু হলে ঠাকুরের ভাবসমাধি হইত; এই কথা বলিতেছেন।
যবনিকা উঠিয়া গেল। রাজপথে নিত্যানন্দ মাথায় হাত দিয়া রক্তস্রোত বন্ধ করিতেছেন। মাধাই কলসীর কানা ছুঁড়িয়া মারিয়াছেন; নিতাইয়ের ভ্রূক্ষেপ নাই। গৌরপ্রেমে গরগর মাতোয়ারা! ঠাকুর ভাবাবিষ্ট। দেখিতেছেন, নিতাই জগাই মাধাইকে কোল দিবেন। নিতাই বলিতেছেন :
প্রাণ ভরে আয় হরি বলি,নেচে আয় জগাই মাধাই ।
মেরেছ বেশ করেছ, হরি বলে নাচ ভাই ॥
বলরে হরিবোল; প্রেমিক হরি প্রেমে দিবে কোল ।
তোল রে তোল হরিনামের রোল ॥
পাওনি প্রেমের স্বাদ, ওরে হরি বলে কাঁদ, হেরবি হৃদয় চাঁদ ।
ওরে প্রেমে তোদের নাম বিলাব, প্রেমে নিতাই ডাকে তাই ॥
এইবার নিমাই শচীকে সন্ন্যাসের কথা বলিতেছেন।
শচী মূর্ছিতা হইলেন। মূর্ছা দেখিয়া দর্শকবৃন্দ অনেকে হাহাকার করিতেছেন। শ্রীরামকৃষ্ণ অণুমাত্র বিচলিত না হইয়া একদৃষ্টে দেখিতেছেন; কেবল নয়নের কোণে একবিন্দু জল দেখা দিয়াছে!
৩০.৮ অষ্টম পরিচ্ছেদ – গৌরাঙ্গপ্রেমে মাতোয়ারা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
অভিনয় সমাপ্ত হইল। ঠাকুর গাড়িতে উঠিতেছেন। একজন ভক্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, কেমন দেখলেন? ঠাকুর হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “আসল নকল এক দেখলাম।”
গাড়ি মহেন্দ্র মুখুজ্জের কলে যাইতেছে। হঠাৎ ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইলেন। কিয়ত্ক্ষণ পরে প্রেমভরে আপনা-আপনি বলিতেছেন,—
“হা কৃষ্ণ! হে কৃষ্ণ! জ্ঞান কৃষ্ণ! প্রাণ কৃষ্ণ! মন কৃষ্ণ! আত্মা কৃষ্ণ! দেহ কৃষ্ণ!”আবার বলিতেছেন, “প্রাণ হে গোবিন্দ, মম জীবন!”
গাড়ি মুখুজ্জেদের কলে পৌঁছিল। অনেক যত্ন করিয়া মহেন্দ্র ঠাকুরকে খাওয়াইলেন। মণি কাছে বসিয়া। ঠাকুর সস্নেহে তাঁহাকে বলিতেছেন, তুমি কিছু খাও না। হাতে করিয়া মেঠাই প্রসাদ দিলেন।
এইবার শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-কালীবাড়িতে যাইতেছেন। গাড়িতে মহেন্দ্র মুখুজ্জে আরও দু-তিনটি ভক্ত। মহেন্দ্র খানিকটা এগিয়ে দিবেন। ঠাকুর আনন্দে যাইতেছেন ও গান আরম্ভ করিলেন।
গৌর নিতাই তোমরা দু ভাই ।
মণি সঙ্গে সঙ্গে গাইতেছেন।
মহেন্দ্র তীর্থে যাইবেন। ঠাকুরের সহিত সেই সব কথা কহিতেছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মহেন্দ্রের প্রতি, সহাস্যে)—প্রেমের অঙ্কুর না হতে হতে সব শুকিয়ে যাবে।
“কিন্তু শীঘ্র এস। আহা, অনেকদিন থেকে তোমার বাড়িতে যাব মনে করেছিলাম, তা একবার দেখা হল বেশ হল।”
মহেন্দ্র—আজ্ঞা, জীবন সার্থক হল!
শ্রীরামকৃষ্ণ—সার্থক তো আছেনই। আপনার বাপও বেশ! সেদিন দেখলাম; অধ্যাত্মে বিশ্বাস।
মহেন্দ্র—আজ্ঞা, কৃপা রাখবেন যেন ভক্তি হয়।
শ্রীরামকৃষ্ণ—তুমি খুব উদার, সরল। উদার সরল না হলে ভগবানকে পাওয়া যায় না। কপটতা থেকে অনেক দূর।
মহেন্দ্র শ্যামবাজারের কাছে বিদায় লইলেন। গাড়ি চলিতেছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মাস্টারের প্রতি)—যদু মল্লিক কি করলে?
মাস্টার (স্বগত)—ঠাকুর সকলের মঙ্গলের জন্য ভাবিতেছেন। চৈতন্যদেবের ন্যায় ইনিও কি ভক্তি শিখাইতে দেহধারণ করিয়াছেন?